নোটের পাহাড় দিয়ে তবে আস্ত মুরগি।
এক বৎসরে দশ লক্ষ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি! অর্থাৎ, গত বৎসর ২৯ অগস্ট যে জিনিসটি ১০০ টাকায় কিনিয়া বাড়ি ফিরিতেন, আজ তাহা কিনিতেই ১০,০০,০০০ টাকা গনিয়া দিতে হইবে। ভারতে বসিয়া এমন পরিস্থিতি কল্পনা করাই কার্যত অসম্ভব, কিন্তু ভেনেজ়ুয়েলায় ঠিক এই কাণ্ডটিই চলিতেছে। লাতিন আমেরিকায় অবশ্য ইহা অ-পূর্ব নহে। গত শতকের আটের দশকটি সেই মহাদেশের ‘বিনষ্ট দশক’ হিসাবে (কু)খ্যাত— তাহা বহুলাংশে এই হাইপার-ইনফ্লেশন বা অতি-মূল্যবৃদ্ধির কারণে। ভেনেজ়ুয়েলার ব্যাধির চরিত্রটি লাতিন আমেরিকার অতীতের অনুরূপ, তবে একটি বড় ফারাক আছে। অনতিপূর্ব অতীতেই উগো চাভেসের নেতৃত্বাধীন ভেনেজ়ুয়েলা লাতিন আমেরিকার সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ দেশগুলির একটি হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার কারণ ছিল দেশের মাটির নীচে। বিশ্বের ভূগর্ভস্থ পেট্রোলিয়ামের বৃহত্তম উৎসটি ভেনেজ়ুয়েলায়। ফলে, পেট্রোলিয়ামের দাম যখন ঊর্ধ্বগামী হইয়াছিল, ভেনেজ়ুয়েলার ডলারের ভাণ্ডারও ছাপাইয়া পড়িতেছিল। দেশের মোট রফতানির ৯৬ শতাংশই ছিল তেল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম মুখ থুবড়াইয়া পড়ায় সর্বাধিক ধাক্কাও খাইয়াছে ভেনেজ়ুয়েলা। সেই ধাক্কা সামলাইবার মতো অভ্যন্তরীণ জোর দেশটির নাই। আমদানির খরচ মিটাইবার মতো টাকা হাতে না থাকায় সেই রাস্তা বন্ধ। খাদ্যপণ্য হইতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, কার্যত সব কিছুর জন্যই ভেনেজ়ুয়েলা আমদানির উপর নির্ভরশীল। সেই রাস্তা বন্ধ হওয়ায় অর্থনীতি স্তব্ধ, মানুষ অনাহারে রহিয়াছেন।
প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে, অথবা ভারতের ন্যায় দেশে কেন এই অবস্থা হয় না— বস্তুত, কখনও হইবে, সেই সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ— কিন্তু ভেনেজ়ুয়েলা বা জ়িম্বাবোয়ের ন্যায় দেশে আকছার হইয়া থাকে, তাহার কারণটি অর্থনীতির আঙিনায় মিলিবে না। কারণটির নাম গণতন্ত্র। ক্ষমতাসীন রাজনীতিকের উপর চাপ বজায় রাখিতে পারার, নজরদারি করিবার ক্ষমতা, প্রয়োজনে সরকার উল্টাইয়া দেওয়ার জোর। গণতন্ত্র এবং ধনতন্ত্র, বিশ্বজয়ী দুইটি ধারণার মধ্যে একটি মস্ত মিল আছে— তাহারা ক্ষমতার পুঞ্জীভবনের বিরোধী। এবং, বিকেন্দ্রিত ক্ষমতার মাহাত্ম্যেই ভারতের ন্যায় দেশ অতিমূল্যবৃদ্ধির বিপদ হইতে বহুলাংশে সুরক্ষিত। ভেনেজ়ুয়েলার বর্তমান বিপদের পিছনে একনায়কতন্ত্রের ভূমিকা সর্বাত্মক। উগো চাভেস শুধু দেশকে পেট্রোলিয়াম রফতানির উপর অতিনির্ভরশীল করিয়া তুলেন নাই। তিনি ডলারের নিরিখে দেশের মুদ্রা বলিভারের দাম বাঁধিয়া দিয়াছিলেন, তেল রফতানি বাবদ পাওয়া টাকার ভরসায় যথেচ্ছ ঋণ করিয়াছিলেন, শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করিয়াছিলেন, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারের সর্বনাশ করিয়াছিলেন এবং আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমাইবার নামে দেশীয় শিল্পক্ষেত্রটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের পুতুল করিয়া তুলিয়াছিলেন। তিনি যখন প্রবল উচ্ছ্বাসে সর্বনাশের পথে যাত্রা করিয়াছিলেন, তাঁহাকে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য গোটা দেশের ছিল না। একনায়কের রাজত্বে সেই সামর্থ্য থাকে না। গণতন্ত্রে থাকে। এবং, সেই কারণেই, যে কোনও মূল্যে গণতন্ত্রকে রক্ষা করিতে হয়। বিশেষত সেই সব নেতার হাত হইতে, যাঁহারা ছাতি বাজাইয়া দাবি করেন, দেশের সব সমস্যার সমাধান একাই করিয়া দিতে পারিবেন।