শৈশব কেড়ে নেওয়ার ঐতিহ্য

পাশ-ফেল মানে তো আসলে শিশুদের শৈশবটাকেই ছিনিয়ে নেওয়া। যে শৈশবে সে নানা কল্পনায়, কৌতূহলে পৃথিবীকে জানতে শেখে, তাকে জানাতে শেখে, জ্ঞানার্জনের সেই সজীব পদ্ধতিটাকেই কবরে ঠেলে দেওয়া এবং নিজেদের দায় সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে অন্যায়ের শিকার শিশুদের ঘাড়েই তাদের ব্যর্থতার দায়টা চালান করে দেওয়া।

Advertisement

পিয়ালী পাল

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

ফাইভে ভর্তি হয়েছিলাম এন্ট্রান্স দিয়ে। ‘মেধাতালিকা’য় বন্ধুরা ছিল নীচের দিকে, অনেক পিছনে। প্রথম হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় সেই আমিই কিনা অঙ্কে পেলাম সাড়ে চোদ্দো, পাশ নম্বরের থেকে আধ কম। রেজ়াল্টে লাল কালির দাগ, দিদিমণির বকুনি, মা-বাবার কাছ থেকে অভিযোগ “পড়াশোনা করছিস না!”, আর কাঁড়ি কাঁড়ি উপদেশ। এর ওপর ছিল প্রাইভেট টিউটরের পেটানি। নিজেকে অপরাধী ভাবা ছাড়া উপায় ছিল না। ‘ফেল’ করা মহাপাপ যে! আর যা-ই হোক, পাশ না করলে যে মানসম্মান থাকবে না, সেটা বিষবাক্য আর চপেটাঘাতের মিলিত শিক্ষায় আমাকে বোঝানো হয়েছিল। অতএব সেটাই ছিল আমার প্রথম ও শেষ বারের মতো ফেল করা। অথচ, কেউ জানতে চায়নি কেন আমার অঙ্ক কষতে ভাল লাগত না। কেন সংখ্যাগুলোকে আমার কিলবিলে শুঁয়োপোকার মতো মনে হত। অথচ, সেই সংখ্যাগুলো এক দিন হয়ে উঠল আমার দিবারাত্রির সঙ্গী। বহু বহু দিন পর যখন গবেষণার কাজে মাঠ-ঘাট ঘুরে সংখ্যা জড়ো করা আর সেগুলোকে ব্যাখ্যা করতে শিখলাম, মনের খবরটা তখন জানতে পারলাম বাস্তব কাজের সূত্র ধরে, সহকর্মী ও কিছু শিক্ষকের সহায়তায়।

Advertisement

শিশুর নিজের পক্ষে এ খবরটা জানা কষ্টকর। সে জন্যই সে ইস্কুলে আসে, শিক্ষকের সাহায্য নিতে। শিক্ষককেই সেটা জানার চেষ্টা করতে হয়। জানতে হলে শিশুর মনের গভীরে ডুব দিতে হয়। চিনতে হয় তাকে, তার চার পাশকে। সে কী পারে না, সে খবর ভুলে হদিস করতে হয় সে কী কী পারে, সেইগুলোর। সে বড় কঠিন কাজ। করতে গেলে গোটা ব্যবস্থাটাকে বদলে ফেলতে হয়। সে চেষ্টা যে একেবারে হয়নি, তা নয়। দেশের অগ্রণী শিক্ষাবিদদের চেষ্টায়, বিশ্বের শিক্ষাপদ্ধতি থেকে জ্ঞানাহরণ করে বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে চালু হল CCE–নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন। কিন্তু সমাজের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত জমে থাকা অন্ধকার সেই চেষ্টায় জল ঢালে। এক দিকে CCE চালু করার জন্য শিক্ষার যে পরিকাঠামো এবং নীতিগত সংস্কার দরকার সেটা করা হল না। অন্য দিকে যুগ যুগ ধরে চলে আসা পাশ-ফেল দিয়ে শিশুদের যোগ্যতা বিচার করার সঞ্চিত আবেগের বিরুদ্ধে যে যুক্তির লড়াই প্রয়োজন ছিল, তার কণামাত্রও দেখা গেল না। সুতরাং, সুযোগ পাওয়ামাত্র আবার পাশ-ফেল ফেরত আনার উদ্যোগ। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ্যেই প্রগতি-বিদ্বেষী। এ সরকারের মতাদর্শগত ভিত্তিই হল পুরনোকে আঁকড়ে ধরা। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার সর্বজনীন অধিকারকেও এই সরকার স্বীকার করে বলে মনে হয় না। তাই পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার এই উদ্যোগ।

আশ্চর্য, রাজ্য সরকারও যেন এই সুযোগটাই খুঁজছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনামা তাকে পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনতে আইনি বাধা দূর করে দিল। অনেকে আনন্দে হাততালি দিচ্ছেন। আবার সে এসেছে ফিরিয়া! এ বার আমাদের মেধার বিস্ফোরণ আটকায় কে!

Advertisement

সত্যিই কি তা-ই? বাস্তবিক শিক্ষার মানে উৎকর্ষ আনার জন্য আমাদের এত হাঁকপাঁক? না কি কারণটা শিক্ষার কঠিন অথচ একমাত্র পথটা— শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাদান এবং গ্রহণের রাস্তাটা এড়িয়ে যাওয়া? যে পথটা, এ রাজ্যের অন্তত কিছু স্কুলের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, দাবি করে সম্পূর্ণ নতুন, পরিবর্তিত শিক্ষা-দর্শন: “কোনও শিশুই ফেল করতে পারে না, তারা ফেল করতে আসে না। তাদের ফেল হওয়াটা আসলে শিক্ষা কর্তৃপক্ষ থেকে শিক্ষক পর্যন্ত সকলের সম্মিলিত ব্যর্থতা।’’ এই বোধ থেকেই চালু হয়েছিল CCE, প্রতি দিনের নিরিখে প্রতিটি শিশুর পৃথক মূল্যায়ন। সে অনেক ল্যাঠা, তার চেয়ে ঢের সোজা পাশ বা ফেল করিয়ে দেওয়া। বাচ্চাদের বেশির ভাগ তথাকথিত ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’, যাদের নেই প্রতিবাদের হক, নেই বাক্যের উপর অধিকার।

তা ছাড়া পাশ-ফেল মানে তো আসলে শিশুদের শৈশবটাকেই ছিনিয়ে নেওয়া। যে শৈশবে সে নানা কল্পনায়, কৌতূহলে পৃথিবীকে জানতে শেখে, তাকে জানাতে শেখে, জ্ঞানার্জনের সেই সজীব পদ্ধতিটাকেই কবরে ঠেলে দেওয়া এবং নিজেদের দায় সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে অন্যায়ের শিকার শিশুদের ঘাড়েই তাদের ব্যর্থতার দায়টা চালান করে দেওয়া। মাঠে জল দিলাম না, সার দিলাম না, আর ফসল না হওয়ার জন্য দায়ী করলাম মাটিকেই!

অথচ, ঊষর, নিষ্ফলা বলে চিহ্নিত মাটিতে যে সোনার ফসল ফলিয়ে তোলা যায়, তার নমুনা এই রাজ্যেই আছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সেগুলোর কিছু কিছু দেখার। এক-একটা স্কুল, একান্তই শিক্ষক ও স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠানে। শিশুরা সেখানে নির্ভয়, তারা প্রশ্ন করে, উত্তর দেয়। তারা লিখতে পারে, পড়তে পারে, অঙ্ক কষতে পারে, নাচতে পারে, গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে। আর পারে, যে পারছে না তাকে টেনে তুলতে।
সম্প্রতি প্রতীচী ও শিক্ষা আলোচনা নামক শিক্ষকদের মঞ্চ কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনেও এমনটাই উঠে এসেছে। এ সব স্কুলে যে মূল্যায়ন হয়, সেটা প্রধানত শিক্ষকের। এক শিক্ষকের কথায়, “আমি কতটা এবং কেন শেখাতে পারলাম না সেটা যদি ভাল ভাবে জানতে পারি, তা হলেই তো অর্ধেক কাজ হয়ে গেল।’’ না, আমাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণে যতই রুশো, ডিউই প্রমুখদের নামে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হোক না কেন, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের এই অভিমুখ গড়ে তোলার নিদর্শন পাওয়া যায় না। প্রথা আমাদের কাছে বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষক।

হয়তো প্রথা থেকে আমরা একটা নিষ্ঠুর আনন্দ পাই। যে ব্যবস্থায় আমরা নিজেরা নিপীড়িত হয়েছি, সেই নিপীড়নের প্রতিশোধ নিই পরবর্তী প্রজন্মের ওপর অত্যাচার চালিয়ে। শিক্ষক তাঁর ছাত্রের ওপর দিয়ে শোধ তুলবেন। শিক্ষাকর্তারা শোধ তুলবেন অধস্তন কর্মচারী ও শিক্ষকদের ওপর দিয়ে। পরম্পরা অটুট থাকবে। শিশু-পীড়নের ভারতীয় ঐতিহ্য আরও আরও উৎকর্ষ অর্জন করবে। মিনু টুডু, সাবিনা বেগম, অজিত বাউরিদের ভবিষ্যৎ মুখ লুকোবে আরোপিত ব্যর্থতার গাঢ় অন্ধকারে।

• ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন