পথিক তুমি কি

ইদানীং ফেসবুকে একটি ব্যাপার চালু হইয়াছে: কোনও ব্যক্তির নামধাম লিখিয়া, তাহার কুকীর্তি ফাঁস করিয়া দেওয়া। কেহ বলিতেছে ইহা সমাজে ভিলেনের সংখ্যা কমাইবে, কেহ বলিতেছে ইহা মানবাধিকারের বিরোধী। চিনা সরকার প্রায় এই পদ্ধতিটিই ব্যবহার করিতেছেন ট্রাফিক অাইন রক্ষা করিতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৭ ০০:০২
Share:

চিন চারটি প্রদেশের বিভিন্ন শহরের প্রশস্ত পথের সন্ধিস্থলে বসাইয়াছে মুখ চিনিয়া লইবার যন্ত্র। যে পথচারী ট্রাফিক আইন না মানিয়া রাস্তা পার হইবেন, অর্থাৎ লাল সিগনালকে পরোয়া করিবেন না, তাঁহার মুখের ছবি এই যন্ত্র তুলিয়া লইবে, ১৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিয়ো চিত্রও তুলিবে সেই লোকটির। সেইটি তখনই দেখানো হইবে ওই রাস্তায় অবস্থিত এক বিশাল পরদায়। তাহার পর, পুলিশের এক কম্পিউটার-তথ্যভাণ্ডারের সাহায্যে, যন্ত্রটি কুড়ি মিনিটের মধ্যে তাঁহার নামধাম ও সমস্ত পরিচয়জ্ঞাপক তথ্য জানিয়া লইবে। তাহার পর বিশাল পরদায় সেই লোকটির পরিচয় সহ ভিডিয়োটি দেখানো হইবে এবং বলা হইবে এই ব্যক্তি এই বেআইনি কাজটি করিয়াছেন। ইহার পূর্বে একটি চটজলদি-খাদ্য বিক্রয়কারী সংস্থা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়াছিল, যাহাতে ক্রেতা আসিলেই যন্ত্রটি তাহার মুখ চিনিয়া লয় এবং তাঁহার ফরমায়েশ আন্দাজ করিতে পারে। কারণ, এক জন লোক সাধারণত একই খাবারের ফরমায়েশ করিয়া থাকেন। খাবারটি আঁচ করিতে পারিলে, ভিড় থাকিলেও দ্রুত সরবরাহের ব্যবস্থা করা সহজ। ইহার পর, চিনেই, সরকারি শৌচাগার হইতে কাহারা শৌচকর্মের জন্য নির্দিষ্ট কাগজের রাশি হাপিশ করিয়া দিতেছে বুঝিবার জন্য এই যন্ত্র বসানো হইয়াছিল। এই বার তাহা ট্রাফিক আইন ভঙ্গের ঘটনা কমাইতে ব্যবহৃত হইল। অপরাধীকে শাস্তি বাছিয়া লইবার একটি সুযোগ দেওয়া হইবে। হয় তিনি আর্থিক জরিমানা প্রদান করিতে পারেন, অথবা ট্রাফিক অাইন সংক্রান্ত একটি ত্রিশ মিনিটের ক্লাস করিতে পারেন, অথবা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকারী অফিসারকে কুড়ি মিনিট সাহায্য করিতে পারেন।

Advertisement

ইদানীং ফেসবুকে একটি ব্যাপার চালু হইয়াছে: কোনও ব্যক্তির নামধাম লিখিয়া, তাহার কুকীর্তি ফাঁস করিয়া দেওয়া। কেহ বলিতেছে ইহা সমাজে ভিলেনের সংখ্যা কমাইবে, কেহ বলিতেছে ইহা মানবাধিকারের বিরোধী। চিনা সরকার প্রায় এই পদ্ধতিটিই ব্যবহার করিতেছেন ট্রাফিক অাইন রক্ষা করিতে। ইহা জারি করিবার ফলে সিগনাল ভাঙিয়া চলাফেরার অভ্যাস বহু পরিমাণে কমিয়া আসিয়াছে বলিয়া চিনা কর্তৃপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন বটে, কিন্তু কেহ বলিতেই পারেন, জরিমানাটুকু আদায় করিয়া বা ক্লাস করাইয়া ছাড়িয়া না দিয়া, বিশাল পরদায় কাহারও মুখ দর্শাইয়া তাহাকে লজ্জায় ফেলিলে, উহা লঘু পাপে গুরু দণ্ড হইতেছে, এক পাপে একাধিক শাস্তি দেওয়া হইতেছে, এবং মানবাধিকার হরণ হইতেছে। যে ব্যক্তি তাঁহার সন্তানের হাত ধরিয়া হাঁটিতেছেন, তাঁহার আইন ভঙ্গ করিবার উপাখ্যান সর্বসমক্ষে বিশাল ছবি দিয়া দেখানো হইলে তাঁহার যে পরিমাণ অবমাননা হইবে, তাহা কি অপরাধের সহিত সমঞ্জস, না বেমানান রকম অতিরিক্ত? চোর বা ডাকাত, এমনকী ধর্ষককেও এই ভাবে লজ্জায় ফেলা হয় না। কেবল কার্যকারিতা দিয়া একটি শাস্তির সার্থকতা মাপা যায় না। যিনি অপরাধী, তাঁহার পরবর্তী মানসিক অবস্থাও খেয়াল রাখিতে হইবে। তিনি কি লজ্জিত হইয়া এই আইন সম্পর্কে সচেতন হইলেন, না, বিষাদ ও আত্মঘৃণায় পীড়িত হইলেন, এব‌ং রাষ্ট্রের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিলেন? চিন সম্পর্কে নিন্দুকেরা যে কথা বলে, এই রাষ্ট্র অত্যন্ত দক্ষ ও অত্যন্ত অমানবিক, তাহাই হয়তো পুনরায়, আপাত-নিরীহ কাণ্ডটিতে প্রমাণিত হইল।

কৌশলটি ভারতে প্রচলিত হইলে সফল হইবার সম্ভাবনা কতটা? এইখানে যন্ত্রগুলি বসানো হইলে, এক মাসের মধ্যেই অধিকাংশই খারাপ হইয়া যাইবে। যন্ত্রগুলির সহিত যুক্ত পুলিশ-তথ্যভাণ্ডারেরও হাজার ত্রুটি ধরা পড়িবে। দেখা যাইবে উধোবাবু রাস্তা পার হইলেন আর বুধোবাবুর নাম ঠিকানা সহ উধোর মুখ প্রদর্শিত হইয়া গেল। তদুপরি, হুড়হুড় করিয়া প্রতি রাস্তায় শত শত লোকের মুখ রেকর্ড করিতে ও তাহাদের পরিচয় খুঁজিতে সুপার-কম্পিউটারেরও পাগলপ্রায় দশা হইবে। ইহাও মনে রাখিতে হইবে, এই শাস্তি প্রক্রিয়ার মূলে আছে যে অনুমান: কাহারও ছবি প্রদর্শিত করিয়া অপরাধের বিবরণ লিখিলে তাহার লজ্জা ঘটে— উহা কি পরদায় নিজ মুণ্ড দেখাইতে সতত উৎসুক জাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? হয়তো এমনিতে নিয়ম মানিয়াই রাস্তা পার হইত, কিন্তু এই বার উৎসাহী ভারতীয় লোক ইচ্ছা করিয়া লাল সিগনালে রাস্তা পার হইয়া, তাহার সন্তানকে বলিবে, একটু দাঁড়াইয়া যাই, কিয়ৎ ক্ষণের মধ্যেই ওই বিশাল পরদায় আমাকে দেখাইবে, নামসহ! কেমন গ্ল্যামার, না?

Advertisement

যৎকিঞ্চিত

জনগণ ফের ঘোলাটে ক্যুইজের মুখোমুখি। জিএসটি কী কেউ জানে না, তা হঠাৎ জারি হল কেন কেউ জানে না, কিসের দাম কমছে কিসের বাড়ছে মুখস্থ রাখতে গিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছে, যদি বাড়ির দাম বাড়ে আর গাড়ির দাম কমে তবে বড়সড় গাড়ি কিনে তার মধ্যেই থাকতে শুরু করা ঠিক কাজ কি না সেও আবছা, ঝাঁটা ও স্মার্টফোন উভয়েরই দাম কমলে হোয়াটসঅ্যাপ বেশি করব না বেশি ঝাঁট দেব তাও ধাঁধা, আর গোরুর মাংসের দাম কমল কি না তা তো জিজ্ঞেস করার সাহসই কারও নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন