সম্পাদকীয় ১

অর্বাচীনতার স্পর্ধা

রাষ্ট্রপুঞ্জের কেরিয়ারেও ইহা একটি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় ইতিপূর্বে কোনও মহাশক্তিমান রাষ্ট্রপ্রধান এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

সাহসিকতা আর বোধক্ষীণতার মধ্যে সীমারেখাটি বরাবরই অতি পিচ্ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়াইয়া জীবনের প্রথম বক্তৃতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাহা বলিলেন, গোলমাল দেখিলেই গোলমেলে দেশকে ‘উড়াইয়া দিবার’ হুমকি দিলেন, শুনিয়া ধন্দ লাগিতে পারে। বিশ্বের শক্তিমানতম নেতাদের অন্যতম তিনি, তাঁহার মুখে এত ভিত্তিহীন হুমকির বর্ষণ তাঁহার সঙ্গে তাঁহার দেশ, এমনকী রাষ্ট্রপুঞ্জকেও কালিমালিপ্ত করিল। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রনেতা কিম জং-আন ভয়ংকর হুমকির পাল্টা হিসাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভয়ংকরতর হুমকি কেবল অশোভন নয়, অসংগত। ইরানের বিরুদ্ধে হত্যালীলা-উপযুক্ত পরমাণু কার্যক্রম চালাইবার অভিযোগ সম্পূর্ণ অবাস্তব। ট্রাম্প কি দুঃসাহসী না অপরিণামদর্শী অতিভাষী, এই মীমাংসা দুস্তর কঠিন। ইরানের প্রেসিডেন্ট পর দিনই রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তৃতায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন, ‘এনরিচমেন্ট’ করার অর্থই পরমাণু বোমা তৈরি, এ কথা যাহারা ভাবে, তাহারা অত্যন্ত অর্বাচীন, সরাসরি ট্রাম্পকে লক্ষ্য করিয়া তিনি এই বাক্যবাণ ছুড়িয়াছেন। দুর্ভাগ্যজনক এই ঘটনার প্রকাশ্য নিন্দা করিয়াছেন ইউরোপের বহু রাষ্ট্রনেতা। মার্কিন চিফ অব স্টাফ স্বয়ং জন কেলি রাষ্ট্রপুঞ্জের হলে বসিয়া নিজের দেশের প্রেসিডেন্টের বক্তৃতাকালে মাথায় হাত দিয়া সাক্ষাৎ অসহায়তার শারীরচিত্র ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম জুড়িয়া প্রেসিডেন্টের ঘোর সমালোচনা ছড়াইয়াছে, বিদেশি প্রচারমাধ্যমে তো কথাই নাই। ব্রিটিশ বিদেশসচিব বরিস জনসনের আক্ষেপ, ‘দেখিতেছি, কেহই সুস্থ অবস্থায় নাই’! ক্ষমতাসীন হইবার পর গত দশ মাসে ট্রাম্প কম বাড়াবাড়ির নমুনা দেখান নাই। তবু সব মিলাইয়া, রাষ্ট্রপুঞ্জে দাঁড়াইয়া এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত রচনা তাঁহার কৃতকর্মের তালিকায় বেশ উচ্চ স্থান দাবি করে।

Advertisement

রাষ্ট্রপুঞ্জের কেরিয়ারেও ইহা একটি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় ইতিপূর্বে কোনও মহাশক্তিমান রাষ্ট্রপ্রধান এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন নাই। রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক হুমকিদাতা হিসাবে ট্রাম্প পথিকৃৎ হইলেন। অবস্থানের তারতম্য বক্তব্যের তারতম্যও বিরাট করিতে পারে। কিম জং-আন-এর হুমকিটি জনৈক ক্ষমতা-উন্মত্ত রাষ্ট্রপ্রধানের বিক্ষিপ্ত বাক্য, কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের সহিত হাত মিলাইয়া কাজ করিতে গিয়া শীর্ষস্থানীয় দেশনেতার সুবিবেচিত বাক্য তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুতর। বাস্তবিক, ট্রাম্প যাহা বলিয়াছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ হইতে তাহার সমালোচনা না হইলে ইহা একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হইয়া থাকিবার সম্ভাবনা। ইতিপূর্বে নাইন-ইলেভেন-এর অব্যবহিত পর প্রেসিডেন্ট বুশ ‘অশুভ অক্ষ’-এর উচ্চারণ করিয়া বিতর্কের মুখে পড়িয়াছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক উচ্চারণ কিন্তু তদপেক্ষা বহু গুণ কাঁচা। আন্তর্জাতিক কূটনীতির অযোগ্য সেই কাঁচাত্ব।

কাঁচাত্বের শেষ এখানেই নয়। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর যে অর্থহীন ধুয়া দিয়া ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট শাসনের সূচনা করিয়াছিলেন, রাষ্ট্রপুঞ্জেও সে দিন একই বক্তব্য তিনি আবার টানিয়া আনিলেন। ব্রিটেন ব্রিটিশদের হউক, আমেরিকা মার্কিনদের হউক, এই মর্মে আবেগ-সমুদ্রে তরঙ্গ তুলিবার চেষ্টা করিলেন। এই প্রয়াস রাজনীতি-অপক্ব জনসভায় চলিলেও রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো পোক্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চের প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত অর্বাচীনতা ছাড়া কিছু নয়। ‘ব্রিটিশ’ বা ‘মার্কিন’ শব্দগুলি একমাত্রিক নয়, প্রতিটির মধ্যেই নানা স্তর, এবং স্তর অতিক্রম চলিয়া থাকে। কিন্তু এ সকল বোধের কথা স্পষ্টতই ট্রাম্পের বিশ্ববীক্ষায় অনুপস্থিত। কিম জং-আনকে লক্ষ্য করিয়া ট্রাম্প ‘আত্মঘাতী’ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন। প্রশ্ন হইল, ট্রাম্পের বিবেচনাহীন স্পর্ধিত বিশ্ববীক্ষার মধ্যেও কি বিশ্বরাজনীতির এক প্রকার আত্মঘাত লুকাইয়া নাই?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন