ফাইল চিত্র।
কয়েক দিন পূর্বেই দিল্লিতে একটি ভূমিকম্প হইয়া গেল। ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই, কেহ হতাহতও হন নাই। কিন্তু একটি ভূমিকম্প হইলেই, কেবল ভূমি নহে, স্থলচর জীবের বিশ্বাসটিই যেন নড়িয়া যায়। যতই আমরা জানি, এ জীবন অনিত্য, এ জগৎ অনিত্য, তথাপি নিজেদের অবস্থানের এক প্রকারের নিত্যতা ধরিয়া লইয়াই আমরা পথ চলিতে অভ্যস্ত। অতি বিশিষ্ট মনীষী, অতি ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদও এই মনোভাব লইয়াই বিরাজ করেন যে যাহা যেমন চলিতেছে, তেমনই চলিবে, সহসা সকলই ধূলিসাৎ হইয়া যাইবার কোনও সম্ভাবনা নাই। কিন্তু ভূমিকম্প হইলে, যাহাকে নিজের সর্বাধিক নিরাপদ আশ্রয় বলিয়া মনে হইতেছিল, তাহাই বিপদের আকর হইয়া দাঁড়ায়, যে ছাদ সকল ঝঞ্ঝা হইতে রক্ষা করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল তাহাই হুড়মুড় করিয়া মাথায় ভাঙিয়া খুলি ফাঁক করিয়া দিবার উপক্রম করে, ছুটিয়া বাহির হইয়া পরিত্রাণের উপায় খুঁজিতে হয়। মানুষ তখন অব্যবস্থিত হইয়া পড়ে, তাহার ভিত্তি কাঁপিয়া উঠে। যে মাটি তাহাকে শক্ত করিয়া ধরিয়া রাখিয়াছিল, সেই মাটিই যদি ফাঁক হইয়া যায়, সে দাঁড়ায় কোথায়? তখন হাঁটিলে ভাল না ছুটিলে ভাল, দক্ষিণ শিবিরের সাহায্য প্রার্থনা বুদ্ধিমানের কাজ না বাম শিবিরের— দ্বন্দ্বগুলি সরিষা-পুষ্পের ন্যায় মাথার চারিপাশে পাক খায়, সেই ভুলভুলাইয়ার ফাঁদে পড়িয়া আরও ভুল করিবার সম্ভাবনা প্রভূত। নিজের সকল সম্পদ ও সম্বল সাদরে সংগ্রহ করিয়া মানুষ সিন্দুকে রাখে। ভূমিকম্প হইলে এই সকলই মুহূর্তে ধ্বংসাবশেষের তলায় গুঁড়া হইয়া যায়। মানুষ তখন প্রকৃত নিঃসহায় হইয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকে। যে ব্যাপারগুলির উপর ভর করিয়া সে প্রখর প্রসন্নতা ও দৃঢ়তা লইয়া ঘুরঘুর করিতেছিল, নিজের ভাস্বর মূর্তি সকলের নিকট উপস্থাপিত করিয়াছিল, সেইগুলি এক নিমেষে মূল্যহীন হইয়া গেল, এই কর্কশ ও আচম্বিত অবিচারকে সে কেমন করিয়া মোকাবিলা করিবে, ভাবিয়া পায় না। যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন, নিত্য এতগুলি জীব মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছে, তাহা দেখিয়াও মানুষ ভাবিতেছে সে অমর, ইহা হইল সর্বাধিক বিস্ময়। কিন্তু তিনি বলিতে পারিতেন, ভূমিকম্প আসিতে পারে জানিয়াও কেহ বা কাহারা নিজ ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি, বা ধর্ম-মেরুকরণের উপর ভর করিয়া নিজ কর্মজীবনকে চিরপ্রতিষ্ঠিত ও দূরগামী ভাবিতেছেন, ইহাই বিস্ময়।
ভূমিকম্প অধিক ভয়াবহ, কারণ কোনও ভাবেই ইহার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নহে। মানুষ এত রকম যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছে, আবহাওয়া বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণীর এত পদ্ধতি রমরম করিতেছে, কিন্তু ভূমিকম্প বিষয়ে তাহার বিন্দুমাত্র সতর্ক থাকিবার উপায় নাই। ভূমিকম্প কখন হইবে তাহা সে অগ্রিম বলিতে পারে না, হইয়া গেলে তখন হাহাকার করিতে পারে মাত্র। তাই ভূমিকম্প তাহার নিকট দৈব দণ্ডের ন্যায় অমোঘ অনিবার্য ও অকস্মাৎ। অনেকে ভূমিকম্প বিষয়ে পাণ্ডিত্য ফলাইতে গিয়াছেন, বাঘা বাঘা বিশারদেরাও কিন্তু ফেল মারিয়া হাত কামড়াইয়াছেন। হয়তো বলিলেন দেখিয়াশুনিয়া নিশ্চিত ভাবে অনুমান করা যায় মাটি এই দিকে ভাঙিবে, কিন্তু মাটির অন্তর্লীন শক্তির প্রভাবে পৃথিবী বিপরীত দিকে বাঁকিয়া গেল।
তাই ভূমিকম্পে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হইলেও, প্রত্যেকের শিক্ষা লওয়া উচিত: এই নাশ যে কোনও মুহূর্তে থাবা মারিতে পারে। সেই আশঙ্কা বুদ্ধিমানকে নিজ স্থিতাবস্থা সম্পর্কে, নিত্য যাতায়াতের মার্গের ভারসাম্য সম্পর্কে সন্দিহান করিয়া তুলিতে পারে, সেইগুলি পুনরায় সমীক্ষা করিতে প্রণোদিত করিতে পারে। আবার, মূর্খের ক্ষেত্রে, সতর্কতা পরিহার করিয়া নিজ অনড় বিশ্বাসের অচলায়তনে মুখ লুকাইয়া ভ্রান্ত নিরাপত্তার কম্বলটি অধিক মুড়ি দিবার আকাঙ্ক্ষাও বাড়াইয়া তুলিতে পারে। অনেকেই মনে করে, দুর্ঘটনা কেবল অন্যেরই ঘটে। তাহার দ্বারপ্রান্তে যখন বিপর্যয় আসিয়া দাঁড়ায়, সে সর্বাধিক অপ্রস্তুত অপ্রতিভ প্রতিপন্ন হয়। হয়তো তখন সে ঘাবড়াইয়া গিয়া, কোনও অস্ত্র খুঁজিয়া না পাইয়া, আতঙ্ক ও অন্ধ প্রত্যাঘাতের তাড়নায়, উৎকট গালি, কুৎসিত এলোপাথাড়ি পাটকেল-প্রয়াস, এইগুলির উপর নির্ভর করে। কিংবা নিজ বস্তাপচা ইষ্টমন্ত্র পুনঃপুনঃ উচ্চৈঃস্বরে জপ করিয়া ভাবে, মাটি নির্ঘাত এখনই শান্ত হইয়া যাইবে। কিন্তু বিধাতা হাসিতে থাকেন। কারণ, লম্ফঝম্প বাগাড়ম্বর পক্বপ্রত্যয় যতই থাকুক, কখন কাহার পায়ের তলার মাটি নড়িয়া উঠিবে ও নড়িয়া চলিবে, বলা দুষ্কর।
যৎকিঞ্চিৎ
রাজস্থানে এক জন ‘বাঙালি’কে খুন করা হয়েছে বলে যদি প্রতিবাদ হয়, দুর্ভাগ্যজনক। এই ভাবে পৃথিবীর কোনও মানুষকে খুন করা হলেই তার প্রতিবাদ করতে হবে, সে খুন যে জাতের মানুষকেই করা হোক, আর রাজস্থানে না হয়ে বেলুচিস্তানে হোক। কান্ডারি বলো মরিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র। যদি এখানে সহমর্মিতা জাত্যভিমানে নির্ভরশীল হয়, তা ততটাই উৎকট, যতটা ছিল উত্তরাখণ্ডে প্রকাণ্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগ: গুজরাতিদের উদ্ধার করার জন্য।