Jail

প্রাপ্যটুকু কবে পাবেন বন্দিরা

২০১২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কনওয়ালজিৎ সিংহ অহলুওয়ালিয়া রাজনৈতিক বন্দিদের একটি মামলা শুনতে গিয়ে সেই তালিকা জেনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন।

Advertisement

রঞ্জিত শূর

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২০ ০১:৫৮
Share:

জেলে ‘কাটমানি’র পরিমাণ, এবং বন্দিদের উপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন বেড়ে গিয়েছে বলে বারুইপুর জেলে বন্দিদের পাল্টা হামলার শিকার হয়েছেন কারাকর্তারা। হাওড়া জেলে ছাদে উঠে ব্লেড দিয়ে বুক চিরে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন আর এক বন্দি। প্রেসিডেন্সি জেলে ‘আইএস সমর্থক’ বলে ধৃত এক বন্দি বিচারের দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগে দু’বার বিচারককে জুতো ছুড়ে মেরেছেন। দমদম জেলে অন্ধকার ঘরে বন্দি করায় আট দিন অনশন করেন এক প্রবীণ বন্দি। রাজ্যের বিভিন্ন জেলে বার বার অনশন আন্দোলনে শামিল হয়েছেন রাজনৈতিক বন্দিরা। দীর্ঘ জেল-জীবনের কষ্ট আর অসুস্থতায় জেরবার মানুষেরা অনশন করছেন চিকিৎসার দাবিতে। বারুইপুর জেলে অভিযোগ, জলের দাবিতে বন্দি-বিদ্রোহ দমাতে মাঝরাতে বাইরে থেকে পুলিশ ঢুকিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল বন্দিদের। বন্দিদের প্রাপ্য সুবিধা না পেয়ে, সেগুলি দাবি করে কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এক বন্দি।

Advertisement

বন্দিদের ‘নিয়মমাফিক বরাদ্দ’ কী? ২০১২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কনওয়ালজিৎ সিংহ অহলুওয়ালিয়া রাজনৈতিক বন্দিদের একটি মামলা শুনতে গিয়ে সেই তালিকা জেনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন। কেবল রাজনৈতিক বন্দি, বা ‘সমাজের বিশিষ্ট মানুষ’ বলে প্রথম ডিভিশন বন্দির স্বীকৃতি পেলে তবেই দাঁতের মাজন, ব্রাশ, আয়না-চিরুনি, লোহার খাট-বিছানা, খবরের কাগজ ইত্যাদি পেতে পারেন বন্দিরা। বিচারপতি আশ্চর্য হয়ে যান। তাঁর নির্দেশ ছিল, হয় সব বন্দির জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক, না হয় রাজবন্দি বা ডিভিশন বন্দির মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হোক। রাজ্য সরকার সব বন্দির জন্য বাড়তি সুযোগসুবিধা চালু না করে ‘রাজনৈতিক বন্দি’ আইনটাই এমন ভাবে পাল্টে দিল, যাতে সহজে আর কেউ রাজনৈতিক বন্দির স্বীকৃতিই পেতে না পারেন।

জেলে আজ বন্দিদের দৈনিক মাথাপিছু ২৫০ গ্রাম চাল এবং ২৫০ গ্রাম আটা বরাদ্দ। তা নিয়ে খুব বেশি অভিযোগ নেই, মূল অভিযোগ খাবারের মান নিয়ে। মাছ, মাংস, মশলা, তেল— সব কিছুর গুণমান নিয়েই বার বার প্রশ্ন উঠেছে। বন্দিদের বেগার খাটানো, আদালতে বা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, পরীক্ষা-পড়াশোনা থেকে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার— সব কিছু নিয়ে নিত্য বিরোধ লেগেই থাকে। অভিযোগ উঠেছে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ, দেখাসাক্ষাতের সুবিধে নিয়ে। কলকাতার তিনটে জেল ছাড়া কোনও জেলে বন্দিদের ফোন ব্যবহারের সুযোগ নেই। জেলে মোবাইল ঢুকিয়ে ও পাকড়াও করে কারাকর্মীদের বাড়তি রোজগার হয় বলে কারা প্রশাসনও নির্বিকার।

Advertisement

বন্দিদের জন্য নিয়মমাফিক সুযোগসুবিধার এক দীর্ঘ ঘোষিত তালিকা আছে সরকারের। তালিকা মতো কিছুই কেন বন্দিরা পান না? কারাকর্তারা বলেন, সরকার টাকা দেয় না। বন্দিরা বলেন, মাঝপথে সব হাওয়া হয়ে যায়। দুর্নীতির কথা কেউই অস্বীকার করেন না। পুকুরচুরি জেল ব্যবস্থারই অঙ্গ বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু আসল কারণ মানসিকতা। সমাজের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত কেউ বিশ্বাসই করে না, জেলে ভাল ভাবে বাঁচার অধিকার আছে বন্দিদের। বন্দিরাও ভাবতে পারেন না যে জেলেও মানুষের মতো জীবন তাঁদের প্রাপ্য। একমাত্র রাজনৈতিক বন্দিরাই জেল ম্যানুয়াল, জেল কোড, ম্যান্ডেলা রুলস— এ সবের ভিত্তিতে দাবি জানান। তালিকা ধরে ধরে প্রশ্ন তোলেন। কারা প্রশাসনের দু’চক্ষের বিষ তাঁরা।

প্রশ্ন হল, কারা দফতরের নিয়ম অনুসারে বন্দিদের যা পাওয়ার কথা, তা পেতে আর কত আন্দোলন করতে হবে? কবে আমরা ভাবতে পারব, জেলবন্দিরাও আমাদেরই সহনাগরিক। এক বার বন্দি হওয়া মানেই জীবন শেষ নয়। চলাফেরার স্বাধীনতা ছাড়া আর সব অধিকারই তাঁদের প্রাপ্য।

প্রাপ্য না পাওয়ার পরিণাম কী হতে পারে, কিছু দিন আগে কলকাতার একটি ইংরেজি দৈনিকে তার বিবরণ ছাপা হয়েছিল। কেরলে ছোটখাটো চুরির জন্য দুই তরুণীকে আদালতে তুললে, উকিল না থাকায় জেলে পাঠানো হয়। বিচার হলে হয়তো তিন মাস সাজা হত। জামিনও হয়ে যেত। কিন্তু তার দ্বিগুণেরও বেশি সময় জেলবন্দি থাকেন তাঁরা। এক বারও আদালতে হাজির করা হয়নি। দু’জনেরই বাড়িতে শিশুসন্তান ছিল। সন্তানের অদর্শন সইতে না পেরে তাঁরা জেলের পাঁচিল টপকে পালান। জেল পালানো, পথে শাড়ি প্রভৃতি চুরি ইত্যাদি একগুচ্ছ মামলা তাঁদের মাথায় চাপে। আসলে তাঁদের উকিলই ছিল না কখনও। তাঁদের কেউই বলেনি, নিখরচায় সরকারই তাদের উকিল দিতে পারে। সরকারেরই সে কথা জানানোর কথা। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট কেউই এক বারও বলেনি, বিধি অনুসারে বন্দির প্রাপ্য কী।

জেলবন্দির যা নিয়মমাফিক পাওনা, তা পেতে শেষ পর্যন্ত আদালতে যেতে হচ্ছে, অনশনে বসতে হচ্ছে বন্দিদের। অধিকাংশ বন্দিই হতদরিদ্র, অল্পশিক্ষিত। ক্ষমতার কাছে নতজানু, সন্ত্রস্ত। নিজের প্রাপ্য চাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। যে বন্দি নিজের প্রাপ্য দাবি করে আদালতে গিয়েছেন, কুর্নিশ তাঁকে। অভিযোগ ধামাচাপা না দিয়ে তা থেকে কি শিক্ষা নেবে প্রশাসন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন