বিলম্ব কেন

এই বিলম্বের ফলে প্রশাসনিক দিকটির সঙ্কট বোঝা কঠিন নহে। নবীন প্রশাসকেরা মহকুমায় কাজে যোগ দিলে মহকুমায় কর্মরত আধিকারিকেরা নূতন দায়িত্ব পাইবেন, প্রশাসনে সচলতা আসিবে। কিন্তু আসল সঙ্কট অন্যত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

সারা দেশে প্রশাসনের কাজে যাহাতে সমতা থাকে, তাহার জন্য ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস-এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণ হইয়া থাকে একত্র, তাহার একটি প্রধান অংশ একটিই প্রতিষ্ঠানে। দুই বৎসরের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য, যে কোনও রাজ্যে প্রশাসকের কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন করিবার দক্ষতা ও মানসিকতা তৈরি করা। প্রশিক্ষণের শেষে মহকুমা স্তরে প্রশাসনের দায়িত্ব লইতে হয় আধিকারিকদের। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ধরনের আইএএস আধিকারিকদের নির্বাচনের পূর্বে জেলায় পাঠাইতে অনাগ্রহী। এই প্রথম নহে, আগেও এমন ঘটিয়াছে। ২০১৫ সালে যে প্রশিক্ষিত আধিকারিকদের এই রাজ্যে পাঠাইয়াছিল কেন্দ্র, তাঁহারা সাত মাস অপেক্ষা করিয়া ২০১৬ নির্বাচনের পরে জেলায় পদ পাইয়াছিলেন। এই বৎসর যাঁহারা রাজ্যে আসিয়াছেন, সেই প্রশিক্ষিত কর্মীদের এখনও জেলায় পদ দেওয়া হয় নাই। জনশ্রুতি, আগামী বৎসরের মাঝামাঝি লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে তাঁহারা মহকুমা স্তরে প্রশাসনের কাজে যোগ দিতে পারিবেন না। অর্থাৎ দুই বৎসর প্রশিক্ষণ, এবং তিন মাস কেন্দ্রের নানা মন্ত্রকে শিক্ষানবিশির পরেও রাজ্যের নানা দফতরে সাত-আট মাস করিয়া কাটাইতেছেন এই আধিকারিকেরা। প্রশাসনের কাজ যখন শ্লথ, যখন বিবিধ উন্নয়ন প্রকল্পের রূপায়ণ গতি হারাইতেছে, বরাদ্দ টাকা প়ড়িয়া আছে, তখন মহকুমা স্তরের পদে নূতন প্রশাসন নিয়োগ করিতে রাজ্যের এই দীর্ঘসূত্রিতার অর্থ কী? দুই বৎসরের প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমে রাজ্যের স্তরে প্রশিক্ষণও হইয়া থাকে। অতএব রাজ্যে আসিয়া আরও সাত-আট মাস অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ নিরর্থক। এতদ্ব্যতীত, এখন কর্মরত আধিকারিকদের জন্য সংক্ষিপ্ত সময়ের নানা প্রশিক্ষণও হইয়া থাকে। অতএব শুরুতে দীর্ঘ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নাই।

Advertisement

এই বিলম্বের ফলে প্রশাসনিক দিকটির সঙ্কট বোঝা কঠিন নহে। নবীন প্রশাসকেরা মহকুমায় কাজে যোগ দিলে মহকুমায় কর্মরত আধিকারিকেরা নূতন দায়িত্ব পাইবেন, প্রশাসনে সচলতা আসিবে। কিন্তু আসল সঙ্কট অন্যত্র। শোনা গিয়াছে, রাজ্যের প্রধান দুশ্চিন্তা নবীন আধিকারিকদের উপর কেন্দ্রের ‘প্রভাব’ লইয়া। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলিতে প্রশিক্ষণের সময়ে তাঁহারা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছেন, সেই প্রভাব কাটাইতে রাজ্যকে ফের ‘প্রশিক্ষণ’ দিতে হইবে, এমন ইঙ্গিত মিলিয়াছে। নির্বাচন অবধি অপেক্ষা সেই কারণেই। এই আভাস যদি সত্য হয়, তবে গণতন্ত্রের জন্য তাহা গভীর উদ্বেগের কারণ। কেন্দ্র ও রাজ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকিবে— গণতন্ত্রে ইহা অস্বাভাবিক কিছুই নহে। তাহাদের নেতারা প্রতিযোগিতা করিয়া প্রশাসনের উপর প্রভাব বিস্তার করিবেন, এমন আশঙ্কার বশীভূত থাকিয়া যথার্থ গণতান্ত্রিক প্রশাসন চালনা করা কঠিন। মনে রাখিতে হইবে, নির্বাচন নিরপেক্ষ করিতেই নির্বাচনের সময়ে সকল প্রশাসক নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ কর্মী বলিয়া বিবেচিত হন। তাঁহাদের উপর রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। থাকিবার কথাও নহে। ‘মগজধোলাই’-এর আশঙ্কা অহেতুক নহে কি?

যে রাজ্য এই বৎসরের পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখিয়াছে, তাহার নাগরিকদের মনে অন্যবিধ আশঙ্কাই বরং স্বাভাবিক। এই বার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসনে ভোট হয় নাই। অভিযোগ, বিরোধীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন নাই, তাঁহারা প্রহৃত এবং অপদস্থ হইয়াছেন, মহিলারাও ছাড় পান নাই। সাংবাদিকরাও নির্যাতিত হইয়াছেন। সংবাদমাধ্যমে এই সকল চিত্র প্রকাশিত হইলেও পুলিশ বা প্রশাসন এই সঙ্কটের কোনও চিহ্ন দেখিতে পায় নাই। এই অভিজ্ঞতা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতায় হানি ঘটায়। প্রশাসনের উপর আস্থাও বাড়ায় না। কে কাহার মগজধোলাই করিতেছে, সেই প্রশ্ন অতএব অনিবার্য।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement