সম্পাদকীয় ২

অনৈক্যসাধন

ভাগ্যে রাজনাথ সিংহ বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পান নাই। অন্যান্য দেশ দূরস্থান, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিষয়েও তাঁহার সাধারণ জ্ঞানের ভয়ংকর হ্রস্বতা অক্লেশে প্রকাশ করিয়া তিনি বলিতে পারেন, আমেরিকা বা ইংল্যান্ড যেমন জনসংখ্যার দিক হইতে তাহাদের সত্তা পাল্টাইতে দেয় না, দিবে না, ভারতেরও নিজের জনসমাজের সংখ্যাগত বিন্যাস সযত্নে (ও সবলে) রক্ষা করা কর্তব্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৫ ০০:৩৩
Share:

ভাগ্যে রাজনাথ সিংহ বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পান নাই। অন্যান্য দেশ দূরস্থান, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিষয়েও তাঁহার সাধারণ জ্ঞানের ভয়ংকর হ্রস্বতা অক্লেশে প্রকাশ করিয়া তিনি বলিতে পারেন, আমেরিকা বা ইংল্যান্ড যেমন জনসংখ্যার দিক হইতে তাহাদের সত্তা পাল্টাইতে দেয় না, দিবে না, ভারতেরও নিজের জনসমাজের সংখ্যাগত বিন্যাস সযত্নে (ও সবলে) রক্ষা করা কর্তব্য। জনসংখ্যার সত্তা বলিতে রাজনাথ সিংহ কী ইঙ্গিত করিতেছেন, তাহা লইয়া সংশয়ের লেশমাত্র নাই, যেহেতু কথাটি উঠিয়াছে ধর্মান্তরকরণ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রসারের কার্যক্রম সম্পর্কে। হিন্দু জনসাধারণকে খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম গ্রহণ করিতে বাধ্য করিয়া হিন্দুসমাজের আকার প্রকার নষ্ট করা হইতেছে, এবং ভারতের জাতিসত্তাটি পরিবর্তন করিবার প্রয়াস চলিতেছে: রাজনাথ সিংহ ও তাঁহার উৎস প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ইহাই বক্তব্য। বাস্তবিক, এই দিক হইতে দেখিলে যে উল্লিখিত দুই দেশেই ‘জাতীয় সত্তা’ আজ অনেক কাল হইল গভীর ও ব্যাপক পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছে, হয়তো রাজনাথ সিংহ অবগত নহেন। খোঁজ লইলেই তিনি দেখিবেন, ব্রিটেন-আমেরিকায় ধর্মীয় পরিচয়ের হার কী ভাবে পাল্টাইতেছে, শ্বেতাঙ্গ অ্যাংলো-স্যাক্সন দ্রুত সংখ্যালঘুতে পরিণত হইতেছে, এবং তাহা লইয়া সরকারি উদ্যোগে রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা অন্তত এখনও উঠিতেছে না।

Advertisement

ভারতে এই ধরনের পরিবর্তন ‘পরিব্যাপ্ত’ বলিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, বকলমে তাঁহাদের সরকার অত্যন্ত দুর্ভাবনাগ্রস্ত। কেন এই অকারণ দুর্ভাবনা? ভারতের বাস্তব এখনও তেমন গভীর মৌলিক চরিত্র পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী নয়। ২০১৪ সালের মে মাসের আগে পর্যন্ত এই তথাকথিত ‘সমস্যা’ আবির্ভূতও হয় নাই। ধর্মান্তরকরণ যে বিরাট ভোলবদলের কারণ, তাহা প্রতিষ্ঠার উপায়ও নাই। অর্থাৎ, স্বরাষ্ট্র বিষয়েও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিভ্রান্ত, সন্দেহ নাই। আর একটি কথা। সমাজ রাষ্ট্রের দাস নয়, রাজনীতির আজ্ঞাবহও নয়। যদি কোনও পরিস্থিতিতে ভারতের জনসমাজে ধর্মসত্তার ভারসাম্যটি সত্যই পাল্টায়, তাহা হইলেও কি রাজনাথ সিংহদের অভিভাবকত্বের দরকার পড়িবে? ভারতে ধর্মান্তরের সহিত সমাজসেবার কিছু সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভাবেই থাকিয়াছে। আবার সমাজের একাংশের দোলাচল সত্ত্বেও বৃহত্তর সামাজিক স্থিতি রক্ষার ইতিহাসও চোখের সামনেই ব্যাপ্ত থাকিয়াছে। রাষ্ট্রের ছড়ি ব্যতিরেকেই।

দারিদ্রপীড়িত অপুষ্টি-অশিক্ষায় জর্জরিত দেশের কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মান্তরের প্রবণতা কেন তৈরি হয়, বোঝা কঠিন নয়। আবার অনেকেই নিজ ধর্মেই নিজ পরিসরটুকু সংশোধিত ও পরিমার্জিত করিয়া লন, সমাজসেবা বা অন্যান্য মহত্তর আদর্শের প্রেক্ষিতে। উনিশ-বিশ শতকের হিন্দু সমাজের দিকে তাকাইলেই তাহা চোখে পড়ে। রাজনীতি দিয়া এই স্বাভাবিক সামাজিক আদানপ্রদানকে থামানো যায়নি, কেবল বিভেদের রাজনীতির বিকাশ ঘটানো গিয়াছে। সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ হইয়া কেউ ধর্ম পরিবর্তন করিবেন কি না, তাহাতে রাষ্ট্রের কিংবা নেতৃত্বের কিছু বলিবার থাকিতে পারে না। সুতরাং ঘর ওয়পসি-র মতো নেতি-নীতিরও যে উদ্দেশ্য, রাজনাথ সিংহের আত্মগর্বী বক্তৃতার পিছনেও ভাবনাটি একই। অনৈক্য সাধন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement