সম্পাদকীয় ১

অযথা যুদ্ধ

নারদ কাণ্ড কি সত্যই এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? সাম্প্রতিক একান্ত সাক্ষাৎকারে ফের এক বার তেমন অভিযোগই করিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযোগটি ঠিক কি না, বিচার করিবার কোনও উপায় আপাতত নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

নারদ কাণ্ড কি সত্যই এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? সাম্প্রতিক একান্ত সাক্ষাৎকারে ফের এক বার তেমন অভিযোগই করিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযোগটি ঠিক কি না, বিচার করিবার কোনও উপায় আপাতত নাই। কিন্তু, ষড়যন্ত্র যদি হইয়াও থাকে, কেহ যদি মুখ্যমন্ত্রীর সহিত শত্রুতা করিয়াও থাকেন— তথাপি নারদ মামলায় কলিকাতা হাইকোর্টের রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলিয়া সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকিবার সিদ্ধান্তটি যে হঠকারিতার নিদর্শন, সে কথা বোধহয় মুখ্যমন্ত্রীও একান্তে স্বীকার করিবেন। প্রথমত, আদালত কোনও অবস্থাতেই শত্রু নহে, ফলে সেই অভিমুখে অহেতুক কামান দাগিবার অর্থ নাই। দ্বিতীয়ত, লড়াইটি রাজ্য সরকারের ছিলই না। নারদ মামলায় যাঁহারা অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁহারা তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির বিভিন্ন মাপের নেতা। অধিকাংশের সহিতই রাজ্য সরকারের কোনও সম্পর্ক নাই। সরকার খামখা সেই লড়াইয়ে জড়াইল। ফল ভাল হয় নাই। সুপ্রিম কোর্ট যে ভঙ্গিতে রাজ্য সরকারের আইনজীবীকে ভর্ৎসনা করিয়াছে, তাহাতে রাজ্যের সম্মান বাড়ে নাই। কাহার দোষে এমন একটি আবেদন সর্বোচ্চ আদালতে পৌঁছাইল, সে বিষয়ে বিস্তর জলঘোলা হইবে— কিন্তু, তাহাতে মূল কথাটি হারাইয়া যাইবে না। যে লড়াই রাজ্য সরকারের ছিল না, আগ বাড়াইয়া সেই লড়াই লড়িতে যাওয়াই কাল হইল। সরকার ও দলের মধ্যে বিভাজিকা না থাকিলে কী বিপত্তি হইতে পারে, ইহা তাহারই নিদর্শন।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকরা হয়তো বিশ্বাসই করিতে পারিবেন না যে দল এবং সরকার এক বস্তু নহে। তাঁহাদের দোষ নাই, সেই বামফ্রন্টের আমল হইতেই দুই সত্তা মিলিয়ামিশিয়া গিয়াছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দল হইতেই সরকার গঠিত হয় বটে, কিন্তু তাহাদের ধর্ম পৃথক, অস্তিত্বও পৃথক। সরকার রাজ্যের প্রশাসনের প্রধান। তাহার কাজ রাজ্যের স্বার্থরক্ষা, কোনও একটি বিশেষ দলের নহে। শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠিলেও তাঁহাদের রক্ষা করিবার দায়িত্ব সরকারের নহে। কেহ বলিতে পারেন, নারদ মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রাজ্যের একাধিক মন্ত্রীও ছিলেন। সেই ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সরিয়া দাঁড়াইতে বলা। মন্ত্রী হিসাবে সরকারের তরফে তাঁহাদের যে সহায়তা প্রাপ্য, এই গোত্রের দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় স্বপ্রবৃত্ত হইয়া তাহা ত্যাগ করাই বিধেয় ছিল। যাঁহারা দুর্নীতিতে জড়িত, রাজ্যের পক্ষে তাঁহারা বিপজ্জনক। ফলে, ইহাই প্রত্যাশিত যে তেমন মানুষের সহিত রাজ্য সরকার রাজ্যের স্বার্থেই কোনও সংস্রব রাখিবে না। যত ক্ষণ না দুর্নীতির অভিযোগ অপ্রমাণ হইতেছে, তত দিন দূরত্ব বজায় রাখাই উচিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিপরীত পথে হাঁটিয়াছে।

দল এবং সরকারের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখিবার কাজটি এক অর্থে কঠিন— তাহার জন্য সরকারের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হইতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সেই শিক্ষা নাই। বাম আমলেও ছিল না, এখনও নাই। ‘আমরা-উহারা’র বিচার এই রাজ্যে মূলগত। দলীয় আনুগত্যের বিনিময়ে প্রশাসনিক ছত্রছায়া এই রাজ্যে অধিকারের পর্যায়ভুক্ত। ফলে, দলীয় নেতাদের লড়াই যে রাজ্য সরকার লড়িতে পারে না, নারদ মামলার ক্ষেত্রে সেই বোধটিই জাগ্রত হয় নাই। দলের স্বার্থরক্ষা যখন প্রশাসনের মূল বিবেচ্য হইয়া উঠে, তখন কর্তব্য-অকর্তব্যের বোধ গুলাইয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনের কোনও কর্তা বলিতে পারেন নাই যে এহেন মামলা দায়ের করা রাজ্যে সরকারের পক্ষে ঘোর অনুচিত হইবে। ইহা শুধু ক্ষণিকের বিচ্যুতি নহে, ইহা এক দীর্ঘলালিত অভ্যাসের ফল। সুপ্রিম কোর্টের কঠোর তিরস্কারেও অভ্যাস বদলাইবে কি? মুখ্যমন্ত্রী কি ভাবিয়া দেখিবেন, দলতন্ত্র কতখানি অপমান ডাকিয়া আনিতে পারে?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন