আত্মঘাত

সেই কবে গ্রিক নাট্যকাররা বলিয়াছিলেন, ক্ষমতা অন্ধ প্রতাপের জন্ম দেয়, আর অন্ধ প্রতাপ শেষ হয় আত্মঘাতে। এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার যে আইআইএম সংস্কার প্রস্তাবটি আনিয়াছে, তাহা দেখাইয়া দেয়, সভ্যতার আদিকাল হইতে আজ পর্যন্ত ক্ষমতার ধর্ম ঠিক একই রকম রহিয়া গিয়াছে।

Advertisement

সম্পাদকীয় ১

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০০:১৩
Share:

সেই কবে গ্রিক নাট্যকাররা বলিয়াছিলেন, ক্ষমতা অন্ধ প্রতাপের জন্ম দেয়, আর অন্ধ প্রতাপ শেষ হয় আত্মঘাতে। এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার যে আইআইএম সংস্কার প্রস্তাবটি আনিয়াছে, তাহা দেখাইয়া দেয়, সভ্যতার আদিকাল হইতে আজ পর্যন্ত ক্ষমতার ধর্ম ঠিক একই রকম রহিয়া গিয়াছে। ক্ষমতার অন্ধ প্রতাপ ও সরকারি দমন-আগ্রহের নির্লজ্জ উদারহণ এই আইআইএম-নিয়ন্ত্রণ প্রস্তাব। ক্ষমতার এই প্রতাপ দেশের স্বার্থের সরাসরি বিপ্রতীপ অর্থাৎ আত্মঘাতী হইতেও বাধ্য। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট তো কেবল ভারতের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান নয়, বিশ্বময় শিল্প-ব্যবসার বৃহৎ মঞ্চে ভারতের যে কয়েকটি গৌরবের ধন এখনও টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছে, প্রশংসা কুড়াইয়া আনিতেছে, তাহার মধ্যে সম্ভবত গোড়ার দিকে এই প্রতিষ্ঠানের স্থান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রক যে কঠিন ও গভীর নিয়ন্ত্রণের ফাঁদে তাহাকে বাঁধিতে উদ্যত, তাহার ফলে সেই স্থান হইতে তাহার ভ্রষ্ট হইবার সম্ভাবনা নিশ্চিত। তিন বৎসর আগে ইউপিএ সরকারের আমলে যে প্রস্তাব আসিয়াছিল, তাহাতেও এই অভিমুখটিই ছিল। তবে এ বারের বিলটি অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণকামী, অধিকতর আপত্তিকর। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানের প্রবর্তক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত থাকিতে পারেন, তাঁহার সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকই দেখাইয়া দিতেছে যে তাঁহার সাধের ভারত-মার্কা ছাপের সর্বনাশ করিতে তাহারা কতটা দক্ষ।

Advertisement

উৎকর্ষের স্বপ্নদ্রষ্টারা অধিকাংশই বুঝিতে পারেন না যে, শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বস্তুটি কিছুতেই উৎকর্ষ-লক্ষ্যের সহিত খাপ খায় না। সরকারি দফতরে বসিয়া কর্তারা নিয়ন্ত্রণের হাজারো পন্থা বাহির করিতে পারেন। শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘গ্রুপ ডিসকাশন’ লাগিবে, মাহিনা বাড়াইতে হইলে সরকারি সহি লাগিবে, বাৎসরিক মাহিনা কত ও কেন অত, তাহার যুক্তি-ব্যাখ্যা সরকারের কাছে পেশ করিতে হইবে, ইত্যাদি। কিন্তু ইগোর তৃপ্তি ছাড়া আর কোনও লক্ষ্য ইহাতে পূর্ণ হইবে না। নিয়ন্ত্রণের আকারপ্রকারই নিশ্চিত করিবে যাহাতে আত্মসম্মান-সম্পন্ন শিক্ষক কিংবা প্রতিষ্ঠান-চালক এই প্রতিষ্ঠানের সহস্রহস্তের মধ্যে না আসেন। অন্যান্য বহু সরকারি দণ্ড-শাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনটিই ঘটিয়াছে। মুক্তির হাওয়ায় কাজ করিতে যোগ্য শিক্ষকরা অন্যত্র চলিয়া গিয়াছেন, বিদেশে পাড়ি দিয়াছেন। এত দিন অনেক সুযোগ্য ব্যক্তি শিল্পক্ষেত্রে লোভনীয় কেরিয়ার ছাড়িয়া আইআইএম-এর গৌরবের অংশী হইতে চাহিতেন, শিক্ষাদান কিংবা পরিচালনায় যোগ দিতেন। নূতন সংস্কার হইলে, ইঁহারা এমন ভুল আর করিবেন না। ভাল শিক্ষকের অভাবে ভাল ছাত্রছাত্রীরাও ক্রমে অন্যত্রগামী হইবেন। প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষের বহতা ধারা শুকাইয়া যাইবে। এই ঘটনা-পরম্পরা সকলেরই সুপরিচিত। ইহার একটি ভারতীয় নামও আছে: ব্রেন-ড্রেন বা মগজ-চালান।

আইআইএম অধিকর্তারা তীব্র আপত্তি জানাইতেছেন। এই আপত্তিকে কেবল প্রতিষ্ঠান-চালকদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ চলিয়া যাইবার আতঙ্ক-প্রসূত প্রতিক্রিয়া ভাবিলে কেন্দ্রীয় সরকার বিরাট ভুল করিবে। আপত্তিটিকে গুরুত্ব-সহকারে বিবেচনা করা দরকার। বোঝা দরকার যে, বহু দশক ধরিয়া একাদিক্রমে গৌরবময় পথরেখা অতিক্রম করিয়া আসা প্রতিষ্ঠানকে যদি বাহির হইতে সাহায্য করিতেই হয়, তবে একটিই উপায়। যে কোনও ভাবে তাহার স্বাধিকার রক্ষা ও বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। বর্তমান প্রস্তাব খারিজ করিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটা। কোনও ‘যদি’ ‘তবে’-র স্থান ইহার মধ্যে নাই। স্বাধিকারের মুক্তি ছাড়া এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ বজায় রাখা অসম্ভব।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন