কোনটি প্রকৃত রোগ, আর কোনটি রোগের উপসর্গ, তাহা বোঝা চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি বিশেষ শিক্ষা। সমাজ-চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই সূত্র প্রযোজ্য। বিদ্যালয়গামী শিশুদের ভারী ব্যাগ যে একটি রোগ নয়, রোগের উপসর্গমাত্র, ইহা তাই দৃষ্টি এড়াইয়া গেলে চলিবে না। শিশুরা ভারী ব্যাগ কাঁধে লইয়া পা টানিতে টানিতে বিদ্যালয় যাইতেছে, ইহা দৃশ্য হিসাবে বিদারক, ইহার ফলে শিশুদের নানাবিধ দৈহিক সমস্যার কথাও অজানা নহে। অনুমান করা চলে তাহাদের মানসিক স্বাস্থ্যও এই কারণে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিত্য দিন সকালে বোঝা টানিয়া রওনা হইবার দুর্ভাগ্য কোনও স্বাধীন জীবনের চিহ্ন হইতে পারে না। জাতীয় শিশু অধিকার সংরক্ষণ কমিশনের নির্দেশ তাই বিলম্বিত হইলেও অত্যন্ত স্বাগত। এ বার কমিশনের সুপারিশ রাজ্য প্রশাসনের এক্তিয়ারে পড়িল: শিশুকে তাহার দুর্বহ ভার হইতে মুক্ত করিবার দায় এখন রাজ্যের ঘাড়ে। যেহেতু বেসরকারি স্কুলগুলিতেই শিশুদের ব্যাগ ভারী করাইবার প্রচলন অধিক, তাই রাজ্য সরকারের কাজটি খুব সহজ-সরল হইবে না। তবে প্রশাসনের কাজ সহজ হইতেই হইবে, এমন শর্তই বা কে কবে দিয়াছে! কিন্তু ইহার পরেও একটি কথা আছে। ভারী স্কুলব্যাগের দর্পণে যে বৃহত্তর সমস্যাটিকে খুঁজিতে হইবে, তাহা বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ছন্নছাড়া চরিত্র। ব্যাগের ওজন কেবল এই ব্যবস্থার দিশাহীনতার বাহ্যিক চিহ্নমাত্র।
বিদ্যালয়ে প্রতিটি বিষয়ের বই লইতে হইবে, প্রতিটি বিষয়ের খাতাও লইতে হইবে, কেননা ক্লাসের পঠনপাঠন তাহা ছাড়া সম্ভব নয়, ইহাই হইল বিদ্যালয়কুলের যুক্তি। যুক্তিটির সমস্যা গভীর এবং মৌলিক। পড়াশোনা বস্তুটি যে আবশ্যিক ভাবেই বইমুখী নহে, বরং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-নির্ভর, ইহা এত দিনে ভুলিয়া যাওয়া হইয়াছে। শিক্ষক একটি বিষয় আলোচনা করিবেন, বুঝাইবেন, প্রশ্ন করিবেন, প্রশ্নের উত্তর দিবেন, এই ভাবেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পঠনপাঠন হওয়ার কথা। আন্তর্জাতিক বোর্ডের বিদ্যালয়গুলিতে আজও তাহা হয়। অনেক বিষয়ের বইও থাকে না। ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার রোগটি ঠিক এইখানে। ভাব ও ভাবনার আদানপ্রদান একেবারে অনাবশ্যক হইয়া পড়ায় বই কাঁধে লইলেই বইয়ের বিষয়বস্তু কাঁধ হইতে মাথায় প্রবাহিত হইতেছে ধরিয়া লওয়া হয়। শিক্ষকদের দায়িত্বও কমে। বিদ্যালয়ের কাজও কমে।
রোগের উপসর্গের বদলে রোগ নিরাময় লইয়া ভাবিতে বসিলে কমিশন কিছু অন্য কথা বলিত। বিদ্যালয়ের কাজ ও ভূমিকা লইয়া আর একটু তলাইয়া ভাবিত। আর তেমন করিয়া ভাবিলে প্রতি বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে ‘লকার’ বানাইয়া খাতাপত্র রাখিবার সুপারিশ পর্যন্ত আসিতে হইত না। যে দেশে বিদ্যালয়ে প্রথম হইতে দশম শ্রেণি অবধি আলাদা আলাদা শ্রেণিকক্ষই নাই, ছাত্রছাত্রীদের বসিবার ব্যবস্থা নাই, পর্যাপ্ত কেন, এমনকী ন্যূনতম সংখ্যক শিক্ষক নাই, টেস্টটিউব তো দূরস্থান, ব্ল্যাকবোর্ড এবং চকও নাই, সেখানে অকস্মাৎ লকার-প্রতিষ্ঠার ভাবনা যাঁহার মাথায় আসিল, তিনি তো পুরস্কারযোগ্য বিশেষজ্ঞ। ছাত্রের নিজের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ব্যাগের ওজন হইতে পারিবে না, এই নিদানের মধ্যেও বিশেষজ্ঞদের অসামান্য মস্তিষ্কতরঙ্গ কাজ করিতেছে। লকার তৈরির আগে বরং বিদ্যালয়ের প্রবেশপথে ওজন-মেশিন বসানো বাধ্যতামূলক হউক। ১০ শতাংশের হিসাব লাগিবে কি না।