ভয়াবহ খনি-দুর্ঘটনা এবং তাহার জেরে সরকারের জনবিরোধী ভূমিকায় তুরস্কের জনসাধারণ বিক্ষোভে উত্তাল। ভূগর্ভস্থ কয়লাখনিতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে অন্তত তিন শতাধিক খনি-শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর আশঙ্কা, কিন্তু সরকারের তরফে উদ্ধার ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত করা হয় নাই, জনসাধারণ বা শ্রমিকদের আত্মীয়-পরিজনদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের যথেষ্ট ব্যবস্থা হয় নাই। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এর্দোগান সপারিষদ অকুস্থল সফরে আসিয়া জিজ্ঞাসু ও আর্ত পরিজনদের সহিত রীতিমত দুর্ব্যবহার করিয়াছেন। তাঁহার নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রশ্নকর্তাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া তাঁহাদের নিগ্রহ করিয়াছে। বিক্ষোভকারীদের প্রতি দমনমূলক আচরণ তো আছেই। সমগ্র তুরস্ক এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার সরকারের উপর যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ।
ক্ষোভের গভীরতর কারণও আছে। এর্দোগানের সরকার কিছু কাল আগেই অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির নামে কয়লাখনিগুলিকে সরকারি ক্ষেত্র হইতে বাহির করিয়া ব্যক্তি-মালিকানায় ছাড়িয়া দেয়। পত্রপাঠ যাঁহারা সেগুলির দখল লন, তাঁহারা সকলেই এর্দোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কর্মকর্তা। অথচ খনি হইতে কয়লা উত্তোলনের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থাও হয় নাই। এক দিকে এর্দোগানের সরকার তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করিতে ক্রমাগত দরবার করিয়া চলিয়াছে। অন্য দিকে খনি-বিস্ফোরণের মতো মারাত্মক ঘটনা ঘটিতেছে। জনসাধারণের ক্ষোভের কারণ কেবল বিস্ফোরণে খনি-শ্রমিকদের মৃত্যু নয়, সেই মৃত্যুর প্রতি শাসকদের নির্মোহ ঔদাসীন্য। এই ঔদাসীন্য, দুর্গতদের উদ্ধারে, ত্রাণে ও চিকিৎসায় সরকারের এই দায়সারা মনোভাবের মধ্যে তাঁহারা স্বৈরাচারী নিষ্ঠুরতা খুঁজিয়া পাইয়াছেন। সে জন্যই তাঁহারা বিক্ষোভে শামিল। অতঃপর সেই বিক্ষোভের উপর পুলিশের দমনপীড়ন তাঁহাদের আরও প্রতিবাদী করিয়া তুলিয়াছে।
গত বছর গ্রীষ্মে রাজধানী ইস্তানবুলে তাকসিন স্কোয়ারে জনসাধারণ এর্দোগান সরকারের স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ দেখাইয়াছিলেন, কায়রোর তাহ্রির স্কোয়ারের মতোই তাহার স্মৃতি এখনও অমলিন। সরকারের বিভিন্ন কার্যকর্তা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তও শেষ হয় নাই। তাহার মধ্যে আবার বিক্ষোভকারীদের প্রতি এর্দোগান সরকারের এই আচরণ একটি ভবিষ্যমুখী, মানবিক রাষ্ট্র এবং উদীয়মান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি রূপে তুরস্কের নন্দিত হওয়ার সম্ভাবনাকেই ক্ষুণ্ণ করিতেছে। এর্দোগান ইতিপূর্বেই তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নষ্ট করিয়া তাহাকে অটোমান খলিফাদের আমলের ইসলামি মৌলবাদের অভিমুখে চালিত করিতে শুরু করিয়াছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মৌলবাদী মোল্লা-মৌলবি-উলেমা-ইমামরা তাঁহার প্রধান গণভিত্তি। নাগরিক, শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি এবং সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরা উত্তরোত্তর এর্দোগানের সামাজিক ভিত্তি হইতে বিচ্ছিন্ন হইতেছেন। টানা দশ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের গদিতে থাকার পর রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের কায়দায় তিনি এখন দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়া খিড়কি-পথে ক্ষমতা ধরিয়া রাখিতে উদ্গ্রীব। তুরস্ক এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এর্দোগানের তুরস্ক কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক নয়। বরং আতাতুর্কের পথ হইতে ক্রমশ অনপনেয় দূরত্বে দেশকে টানিয়া লইতেছেন এর্দোগান।