বাঙালিরা সাহেবদের সাহচর্যেই ‘আধুনিক’ অভিধান নামক বস্তুটির সহিত পরিচিত হইয়াছিল। সংস্কৃতে শব্দতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, অর্থতত্ত্ব লইয়া গ্রন্থ ও তাহার টীকা, ভাষ্য, কারিকা রচিত হইয়াছিল কিন্তু আধুনিক অর্থে অভিধান অন্য বস্তু। সাহেবরা এ দেশের ভাষা রপ্ত করিবার জন্য উনিশ শতকে অভিধান প্রস্তুত করিয়াছিলেন। সাহেবদের অভিধান বিজাতীয়দের ভারতীয় ভাষা শিক্ষার অভিধান। সাহেবদের দেখাদেখি বঙ্গজদের অভিধান চর্চা। বাঙালি পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে দ্বিভাষী। ইংরাজি তাহার জ্ঞানের ভাষা বিশ্বের জানালা খুলিবার ভাষা। এই ভাষা শিক্ষার প্রতি ভদ্রলোক বাঙালির মনোযোগ দীর্ঘদিনের। শিখিবার উপকরণের প্রতি তাঁহাদের আবেগ দীপ্তিময়। জে সি নেসফিল্ড-এর ব্যাকরণ বই আর অক্সফোর্ডের অভিধান ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোক বাঙালির হ্যান্ডবুক। অক্সফোর্ডের অভিধানখানি শিয়রে রাখিয়া চক্ষের উপরে ইংরাজি কাগজ খুলিয়া কত ইংরাজিপিপাসু ভদ্রলোকের দিনযাপন। অক্সফোর্ডের ইংরাজি অভিধানটি রূপে রূপান্তরে সংস্করণে সংস্করণান্তরে বঙ্গজীবনের অঙ্গ হইয়া উঠিয়াছে। দাদুর অভিধান নাতিরও অভিধান। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই বার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন তাঁহারা অক্সফোর্ডের মূল অভিধানের (ও ই ডি) পরিমার্জিত নব্য সংস্করণটি আর গ্রন্থাকারে প্রকাশ করিবেন না, অনলাইন পেশ করিবেন। শিয়রে স্থাপনের নহে, কম্পিউটারে দেখিয়া শিখিবার নব্য অভিধান।
সিদ্ধান্ত উত্তম। অভিধানের গ্রন্থ সংস্করণ অপেক্ষা অনলাইন সংস্করণ অনেক বেশি ব্যবহারোপযোগী। কোন শব্দের উচ্চারণ কেমন, তাহা অভিধান নামক গ্রন্থে ধ্বনিলিপির মাধ্যমে বোঝানো থাকিত। অনলাইন অভিধানে ক্লিক করিলেই উচ্চারণ কানে শোনা সম্ভব। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে শুনিবার বিকল্প নাই। দ্বিতীয়ত, অভিধানে শব্দ অনুসন্ধানের জন্য বিস্তর পাতা উলটাইতে হইত। অনলাইন অভিধানে সার্চের খোপে শব্দটি টাইপ করিয়া ক্লিক করিলেই এক লহমায় স-উচ্চারণ অর্থ হাজির। শব্দের উৎপত্তি, স-উদাহরণ প্রয়োগ সবই মুহূর্তমধ্যে মিলিবে। খোঁজার সুবিধা, সময় বাঁচিবে। চাহিলে সমার্থক শব্দ হাতের তালুতে। আর কী কাম্য হইতে পারে? অনেকে বলিতে পারেন অনলাইন অভিধান দেখিবার সুবিধা সকল ভারতীয়ের নাই। ঠিক। তবে অক্সফোর্ডের ইংরাজি অভিধান কিনিবার ও চাখিবার সামর্থ্যও কি সকল ভারতীয়ের আছে? আর, ক্রমশই ভারতে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাইতেছে। সুতরাং অনলাইন অক্সফোর্ডের ইংরাজি অভিধান সকল দিক হইতেই ভারতীয়দের প্রয়োজন মিটাইবে বলিয়া মনে হয়।
এই সূত্রে বঙ্গজদের কিছু শিখিবারও রহিয়াছে। সাহেবদের অভিধান নির্মাণ দেখিয়া একদা বাঙালি অভিধান নির্মাণে সচেষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু তাহার পর? ভাষা যেমন প্রবহমান, পরিবর্তনশীল তেমন অভিধানও নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিমার্জন করিয়া লইতে হয়। তাহা না করিলে অভিধান প্রয়োজনে লাগে না। ইহা কোনও এক জন ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নহে। বাংলা ভাষা চিন্তকেরা দল বাঁধিয়া কাজে লাগিতে পারেন। অক্সফোর্ড ইংরাজি অভিধানের পরিমার্জন টিমওয়ার্ক। বাংলা অভিধানের পরিমার্জনে যোগ্য বাঙালির সমবেত উদ্যোগ আবশ্যক। এ ছাড়াও চাই নিত্য নূতন অভিধানের পরিকল্পনা ও রূপায়ণ। বাংলা ভাষা মরিয়া যাইতেছে বলিয়া কাঁদিয়া কী হইবে? অভিধান ভাষা শিক্ষার ও ব্যবহারের উপযুক্ত আয়ুধ। বাংলা ভাষার আধুনিক উপযুক্ত অভিধান নাই। অনলাইন তো পরের কথা, এমনকী গ্রন্থরূপও নাই। সাহেবদের দেখিয়া শেখা উচিত। বাঙালি শিখিবে কি?