সম্পাদকীয় ২

নব্য ফারাও

মিশরের সেনানায়ক আবদেল ফতাহ্ আল-সিসি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াছেন। তিনি নাকি ৯৩ শতাংশ ভোট পাইয়া একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থী হামদিন সাবাহিকে পরাস্ত করিয়াছেন। বাকি সাত শতাংশ ভোটই বা কেন তাঁহার বাক্সে পড়িল না, তাহাই বোধ করি প্রকৃত রহস্য। সে ক্ষেত্রে তিনি দেশের একশো শতাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়ার দাবি করিতে পারিতেন। নির্বাচনের আগে দেশবাসীর কাছে তাঁহার প্রত্যাশা যে তেমনই ছিল, তাহা গোপন নাই। বস্তুত, গত দশ মাস ধরিয়া সরকার ও গণমাধ্যম ক্রমাগত আল-সিসি-র পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য দেশবাসীকে যত ভাবে প্ররোচিত করিয়াছে, তাহার নজির মেলা ভার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৪ ০০:০৯
Share:

মিশরের সেনানায়ক আবদেল ফতাহ্ আল-সিসি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াছেন। তিনি নাকি ৯৩ শতাংশ ভোট পাইয়া একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থী হামদিন সাবাহিকে পরাস্ত করিয়াছেন। বাকি সাত শতাংশ ভোটই বা কেন তাঁহার বাক্সে পড়িল না, তাহাই বোধ করি প্রকৃত রহস্য। সে ক্ষেত্রে তিনি দেশের একশো শতাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়ার দাবি করিতে পারিতেন। নির্বাচনের আগে দেশবাসীর কাছে তাঁহার প্রত্যাশা যে তেমনই ছিল, তাহা গোপন নাই। বস্তুত, গত দশ মাস ধরিয়া সরকার ও গণমাধ্যম ক্রমাগত আল-সিসি-র পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য দেশবাসীকে যত ভাবে প্ররোচিত করিয়াছে, তাহার নজির মেলা ভার।

Advertisement

মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মহম্মদ মুর্সির নির্বাচনের সময় অন্তত ৫৪ শতাংশ ভোট পড়িয়াছিল। আল-সিসির বেলায় তিন দিন ধরিয়া ভোটগ্রহণ পর্ব দীর্ঘায়িত করা সত্ত্বেও ৪০ শতাংশ মানুষও ভোট দিতে যান নাই। লক্ষণীয়, ভোট দিতে যাওয়ার জন্য সরকার, গণমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন জনতাকে রীতিমত পীড়াপীড়ি করিয়াছে। উপর্যুপরি ছুটি ঘোষণা করিয়া ভোটদাতাদের বুথে টানিবার চেষ্টা চলিয়াছে। কমিশনের কর্মী-অফিসাররা পাড়ায়-পাড়ায় চোঙা ও হাত-মাইক ফুঁকিয়া জনে-জনে ভোট দিতে বলিয়াছেন। ভোট না দিলে জরিমানার শাস্তিও প্রচারিত হইয়াছে। তথাপি একের পর এক বুথ জনশূন্য থাকিয়াছে। ৪০ শতাংশের পরিসংখ্যানেও তাই প্রভূত জল মিশ্রিত আছে বলিয়া সন্দেহ হয়। মুসলিম ব্রাদারহুড এই নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়াছিল। তবে কি মিশরের জনসমাজে এখনও ব্রাদারহুডের আবেদন সক্রিয়? শারীরিক ভাবে ব্রাদারহুডকে নির্মূল করিতে আল-সিসির ফৌজি শাহি কম কড়াকড়ি করে নাই। গত এক বছরে অন্তত ১৪০০ ব্রাদারহুড নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হইয়াছে। বিচারবিভাগকে দিয়া মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হইয়াছে আরও সমসংখ্যক সমর্থকের। জেলবন্দি রাখা হইয়াছে ১৬ হাজার ব্রাদারহুড কর্মীকে। মহম্মদ মুর্সি স্বৈরাচারী হইয়া উঠিতেছিলেন, এই অজুহাতে তাঁহাকে— মিশরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সর্বপ্রথম জয়ী এক অসামরিক রাজনীতিককে— আল-সিসির জুন্টা সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করে। সে সময় পশ্চিমী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যে পরিপুষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ, উদারনৈতিক শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিও আল-সিসির পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন।

বছর না ঘুরিতেই তাঁহারা নিজেদের সেই ভ্রম উপলব্ধি করেন। ফৌজি জেনারেল কী ভাবে গণতন্ত্রীদের সমর্থন লইয়া কালক্রমে নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার পটভূমি রচনা করিতেছেন, তাহা বুঝিতে পারেন। তত ক্ষণে দেরি হইয়া গিয়াছে। আল-সিসির প্রশাসন যখন একের পর এক নাগরিক অধিকার কাড়িয়া লইতেছে এবং তাহরির স্কোয়ারের গণতান্ত্রিক অর্জনগুলি খর্ব করিতেছে, তখন তাঁহারা এই নির্বাচনের প্রতি বিমুখ হইয়া পড়েন, কার্যত এই ভোট বয়কটই করেন। প্রাপ্ত ভোটের অঙ্ক তাই আল-সিসির গণতান্ত্রিক বৈধতা অর্জনের ব্যর্থ প্রয়াস হইলেও সেই অঙ্কের অভ্রান্ততা লইয়া সংশয় সকলেরই। ফৌজি জেনারেলরা যখনই সেনা-ছাউনির বাহিরে আসিয়া অসামরিক শাসনপ্রণালীর হাল ধরিতে উদ্যোগী হন, তখনই নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বের মহিমা অর্জনের চেষ্টা চালান। কিন্তু সামরিক উর্দিটি এত নাছোড় ভাবে সর্বাঙ্গে সাঁটিয়া থাকে যে, সহসা তাহা খুলিয়া ফেলাও দুঃসাধ্য হইয়া ওঠে। আল-সিসির গণতান্ত্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণতিও খুব সুখকর হইবে বলিয়া মনে হয় না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement