স্কুলের সামনে রানাঘাট প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্যরা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
রানাঘাট কনভেন্ট-কাণ্ডের তদন্তভার শেষপর্যন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনার পরেই স্বাভাবিক নিয়মে তদন্ত শুরু করেছিল রাজ্য পুলিশ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিবৃতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা সিআইডিকে। তার চার দিনের মাথায় বুধবার দুপুরে টুইট করে ও নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিবৃতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই তদন্তের কথা ঘোষণা করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, “ঘটনার গুরুত্ব এবং সংবেদনশীলতা বিচার করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। রাজ্য পুলিশকে বলা হয়েছে, অপরাধীদের গ্রেফতার করতেই হবে। পুলিশ ভাল কাজও করছে। কিন্তু, ঘটনার গুরুত্ব এবং ঘটনাস্থল সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় সিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।” মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, তদন্তের কাজে তাঁর প্রশাসন সিবিআইকে সব রকম সহযোগিতা করবে।
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করে যে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং পথে নেমেছিলেন, তাঁর দিক থেকেই এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনে স্বভাবতই চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক শিবিরে। বিরোধীদের বক্তব্য, পুরভোটের আগে চাপের মুখে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। দু’দিন আগেই রানাঘাটে গিয়ে ওই কনভেন্টের ছাত্রছাত্রী-অভিভাবক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশি তদন্তে ক্ষোভ জানিয়ে স্থানীয় মানুষ সে দিন সিবিআই তদন্তের দাবিও তুলেছিলেন। স্থানীয় মানুষের ক্ষোভের আঁচ পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী সিবিআইকে দায়িত্ব দিলেন বলে বিরোধীদের একাংশের ব্যাখ্যা। শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহারের মতো কেউ কেউ আবার বলেছেন, সে দিন ঘটনাস্থলেই সাধারণ মানুষকে সিবিআই তদন্তের কথা জানিয়ে এলে মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হত। এখন ঘোষণা করায় একে রাজনৈতিক পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের সিবিআই তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারছেন তাঁর প্রশাসন ব্যর্থ। পুলিশ প্রশাসন তৎপর হলে কি আর সিবিআইকে দিতে হত?” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্ন, “নিষ্ক্রিয় পুলিশের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে?”
গত ১৪ মার্চ রাতে রানাঘাটের ওই কনভেন্টে দুষ্কৃতীদের হাতে ধর্ষিত হন সত্তরোর্ধ্ব এক সন্ন্যাসিনী। চার অভিযুক্তের ছবি এবং তিন জনের স্কেচ হাতে থাকা সত্ত্বেও ঘটনার পাঁচ দিন পরেও এই ঘটনায় এক জনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি সিআইডি। বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশের চাপ বাড়ছিল রাজ্যের উপর। উত্তাল সংসদে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও রাজ্যের কাছে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট এবং কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। এ দিন মুখ্যসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজিকে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়ে নোটিস পাঠিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যকে সেই রিপোর্ট পাঠাতে হবে বলে কমিশন জানিয়েছে।
এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ রানাঘাটে পৌঁছন ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স অব ইন্ডিয়া-র সভাপতি ব্যাসেলিয়স কার্ডিনাল ক্লেমিস। কেরল থেকে আসা ওই কার্ডিনাল কলকাতা বিমানবন্দর থেকে সোজা যান ওই কনভেন্টে। সেখানে কিছু ক্ষণ কথা বলার পর তিনি হাসপাতালে ওই নির্যাতিতা সন্ন্যাসিনীকে দেখতে যান। সেখানে প্রার্থনাও করেন। কার্ডিনাল বলেন, “এটি একটি জঘন্য অপরাধ। এখানে এসে দেখলাম সাধারণ মানুষ আমাদের পাশে রয়েছে। মানুষ প্রতিবাদ করছে। এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। দোষীদের গ্রেফতার করে কড়া শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।” তখন যদিও মমতা সিবিআই তদন্তের কথা ঘোষণা করেননি। এ দিন বিকেলে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা। কার্ডিলান জানান, ভ্যাটিকানকে এ বিষয়ে জানানো হবে কি না তা ঘটনাস্থল ঘুরে গিয়ে তাঁরা বিবেচনা করে দেখবেন।
কনভেন্টের সামনে এ দিন সকাল থেকেই প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের একাংশ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এলাকারই বেশ কয়েকটি অরাজনৈতিক সংগঠন। নদিয়া জেলায় ১২টি এবং মুর্শিদাবাদে ৫টি মিশনারি স্কুল রয়েছে। সেখানকার অনেক ছাত্রছাত্রী রানাঘাটে এসেছেন। চাপড়ার একটি চার্চ থেকে এসেছেন ফাদার রবীন মণ্ডল। তিনি জানান, নদিয়ায় প্রায় ৬০-৬৫ হাজার খ্রিস্টান ধর্মের মানুষ বাস করেন। এই ঘটনায় তাঁরা সকলে মিলে প্রতিবাদে নামছেন বলে জানিয়েছেন ওই ফাদার। তিনি বলেন, “এখনও দুষ্কৃতীরা ধরা না পড়ায় আমাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার মনোভাব তৈরি হয়েছে।”
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের সিদ্ধান্তে স্বভাবতই খুশি রানাঘাট। রাজ্য পুলিশ এবং সিআইডি এই ক’দিনে কোনও সাফল্য না পাওয়ায় সিবিআইয়েই আস্থা রাখছে তারা। রানাঘাট প্রতিবাদী মঞ্চ এ দিন সকাল থেকেই দোষীদের গ্রেফতার এবং কড়া শাস্তির দাবিতে স্কুলের সামনে ধরনায় বসেছে। যত দিন না এই ঘটনার কিনারা হচ্ছে, তত দিন এই ধরনা চলবে বলে মঞ্চের তরফে জানানো হয়েছে। তারা জানিয়েছে, সিআইডি অথবা সিবিআই নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। অপরাধীদের শাস্তি হওয়াটাই আসল লক্ষ্য।