Lok Sabha Election 2024

‘মাঝি-মোদী’ ও ভাওয়াইয়া

প্রথম দফায় পশ্চিমবঙ্গের তিন আসনে ভোটগ্রহণ। প্রথম তালিকায় বাকি দুই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দিলেও বিজেপি নেতৃত্ব এড়িয়ে গিয়েছিলেন জলপাইগুড়িকে।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৩৫
Share:

জলপাইগুড়ির বিদায়ী বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায়। — ফাইল চিত্র।

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে গান ধরলেন ডাক্তারবাবু। জলপাইগুড়ির বিদায়ী বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায়। এ বারের প্রার্থীও। গাইলেন, “বৈঠা মারো বৈঠা মারো রে ও বাইছার ভাইয়া রে।” গানের পরিচিতি করালেন এ ভাবে, “এটি ভাওয়াইয়া এবং বাংলাদেশের ভাটিয়ালির মিশ্রিত গান।” আদতে গানটি গোয়ালপাড়ার কথ্য ভাষায় রচিত। গোয়ালপাড়িয়া ভাওয়াইয়াও। জয়ন্তের মুখে গোয়ালপাড়া উহ্য রইল যে! অনিচ্ছাকৃত বচন-বিভ্রাট কি?

Advertisement

হাসতে হাসতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এক কার্যকর্তা বললেন, “ওই গোয়ালপাড়া-গেরোতেই তো জয়ন্তবাবুর টিকিট আটকে ছিল।” প্রথম দফায় পশ্চিমবঙ্গের তিন আসনে ভোটগ্রহণ। প্রথম তালিকায় বাকি দুই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দিলেও বিজেপি নেতৃত্ব এড়িয়ে গিয়েছিলেন জলপাইগুড়িকে। ফলে শেষ দিনে গিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে হয়েছে জয়ন্তকে। গত লোকসভা নির্বাচনে যিনি এক লক্ষ ৮৬ হাজারের ব্যবধানে জিতেছিলেন। সঙ্ঘের কার্যকর্তা মনে করালেন, গত বিধানসভা ভোটে বঙ্গে বিজেপির পরাজয়ের পরে, উত্তরবঙ্গে বিজেপির যে ক’জন জনপ্রতিনিধির মুখে পৃথক রাজ্যের ইঙ্গিত ঘুরেফিরে এসেছিল, জয়ন্ত তাঁদের অন্যতম (একই সুর শোনা গিয়েছিল আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বার্লার কণ্ঠেও)। সঙ্ঘের নিষেধ অমান্য করে সাংসদ নাকি অসমের ধুবুরি, যা কি না অবিভক্ত গোয়ালপাড়ার অংশ, সেখানে গিয়ে সঙ্ঘের ‘অপছন্দের’ কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। তাতেই এ বারে জয়ন্তের টিকিট কাটা গিয়েছিল প্রায়। বিজেপির অন্দরের আলোচনা, দল তো বটেই, সঙ্ঘও এখন রাজ্যভাগের ‘তাস’ বার করতে রাজি নয়। কিন্তু পছন্দের বিকল্প না পেয়ে বিদায়ী সাংসদকেই ‘মেনে নিয়েছে’ সঙ্ঘ।

তৃণমূলের কটাক্ষ, ধূপগুড়ির বিধায়ক নির্মলচন্দ্র রায় তাদের প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ‘ডাক্তারের’ গলায় গান এসেছে। নির্মলচন্দ্র দীর্ঘদিন ধরেই ভাওয়াইয়া গানের চর্চা করেন। ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে নির্মলচন্দ্র রাজবংশী ভোট বেশি পেয়েছিলেন, মানেন বিজেপি নেতারাও। তাই রাজবংশী মন টানতেই কি রাজবংশী সুর বাঁধছেন জয়ন্ত? বলা হয়, জলপাইগুড়ি লোকসভায় অন্তত ২৭ শতাংশ রাজবংশী ভোট রয়েছে। এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়েও তাদের একটা অংশে ক্ষোভের হাওয়া বইছে। তবে বিজেপির মনোনয়ন মিছিলে সিএএ-তে সন্তুষ্ট মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশের উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া। রাজবংশী ভোটে ক্ষয় যদি হয়, পুষিয়ে দেবে মতুয়া ভোট— দাবি গেরুয়া শিবিরের।

Advertisement

যদিও সেই অঙ্ক নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। না হলে মতুয়া ভোট পেয়েও কী ভাবে ধূপগুড়ির উপনির্বাচনে হারে বিজেপি? আর সিএএ নিয়ে তাদের সংশয়ও কাটেনি পুরোপুরি।

ঘরে-বাইরে বিপদে বুঝেই বসন্তে গান ধরেছেন জয়ন্ত? বিজেপি প্রার্থী বলেছেন, “আমি যে গান গাইলাম, তার অর্থ মাঝিকে জোরে জোরে বৈঠা মারতে বলা হচ্ছে। বাইছার ভাইয়া মানে মাঝি। আমাদের মাঝি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।”

তিস্তা পারের জলপাইগুড়ি নৌকা চেনে, নদী চেনে, ঝড়ও চেনে। এই সে দিন ‘টর্নেডো’র রাতে জলপাইগুড়ি দেখেছিল, এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরদিন এসেছিলেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী। ঝড়ের পরে প্রথম এসে মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূলকে যদি কিছুটা এগিয়ে দিতে পেরে থাকেন, ত্রাণ বিলি নিয়ে অভিযোগ আবার শাসক দলের ‘অস্বস্তি’ বাড়িয়েছে। অথচ, তারা তো গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির থেকে ১২ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছিল। বিজেপির অন্যতম ‘ভোট-ব্যাঙ্ক’ বলে পরিচিত আদিবাসী মহল্লায় শ্রমিকদের জমির পাট্টা এবং বাড়ি তৈরির এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিচ্ছে তৃণমূল সরকার। তার পরেও তৃণমূল পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই কেন?

দলের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে চিরন্তন ‘অন্তর্দ্বন্দ্বের’ গল্প। যা মেটাতে সম্প্রতি বার্তাও দিয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষনেত্রী। হাওয়ায় প্রশ্ন ভাসছে, কেন মালবাজারে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় লোক হয়নি ‘তেমন’? ডাকাবুকো তৃণমূল নেতাদের অনেককেই ভোট-প্রচারে তেমন দেখা যাচ্ছে না কেন? তৃণমূল প্রার্থী অবশ্য দাবি করছেন, “আমরা সবাই এক সঙ্গেই পথ চলছি।”

সিপিএমের তরুণ প্রার্থী দেবরাজ বর্মণের মিছিলে কিন্তু যুব সম্প্রদায়ের ভিড় চোখে পড়ছে। আলোচনাও চলছে: গত লোকসভায় হারানো ভোট কি ফেরত পাবে বামেরা? যদি ফেরে, তা হলে সে ভোট ফিরবে কাদের বাক্স থেকে? প্রশ্ন সহজ, উত্তরও জানেন রাম-রহিম সকলেই। এর মধ্যে কংগ্রেসের ক্ষোভের কাঁটাও আছে। প্রার্থী দেওয়ার আগে বামেরা আলোচনায় না ডাকায় জেলা কংগ্রেসের একাংশ ‘অভিমানী’।

শীত-বসন্তে ক্ষীণ হতে থাকা তিস্তায় চৈত্রের হাওয়া মাঝে মাঝে ঢেউ তুলছে। পাক খাচ্ছে এমনই সব বৈঠার ঝাপট। মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এ জলপাইগুড়ির ভূমিপুত্র দেবেশ রায় শুনিয়েছিলেন তিস্তায় সেচখাল কাটার, ‘উন্নয়ন’ শুরু হওয়ার কাহিনি। এবং শেষে সেই সব নাগরিক-রাজনৈতিক উন্নয়নে মোহভঙ্গ হয়ে আর একটা ‘নদী’ খুঁজতে বাঘারুর বেরিয়ে পড়ার গল্প। সেই খাল অনেক গ্রামেই পৌঁছয়নি, বা পৌঁছলেও তাতে জল নেই। ক্রান্তির কৃষক মনসুর মিঞায় কথায়, “সেই ছোটবেলা থেকে খালের জল পাব বলে শুনছি, তিন কুড়ি পার করেও শুনেই চলেছি।” তৃণমূল সরকার নতুন কিছু খাল কেটেছে। তাতেও জল-সমস্যা মেটেনি। তা নিয়েও কেন্দ্র ও রাজ্যের টানাপড়েন আছে।

গ্রামে-গঞ্জে বিজেপির পতাকার দেখা না থাকলেও রয়েছে নতুন রাম পতাকা। আগামী ১৯ এপ্রিল ভোটের দু’দিন আগেই রামনবমী। পতাকার সংখ্যাও বাড়বে। সেই সব পতাকা দুলিয়ে দেওয়া হাওয়া যদি ভোটকেন্দ্র ছুঁয়ে যায়...। কারণ, বিজেপি প্রার্থীর দাবি অনুযায়ী, মাঝি মোদী হলেও, এ বার পারে নাও ভেড়ানো সহজ না-ও হতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন