নির্মীয়মান সেই সেতু। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
ঠা ঠা রোদ্দুর। সঙ্গে হালকা হাওয়া বইছে। মাঝেমধ্যে সেই হাওয়া যখন একটু তীব্র হচ্ছে, মনে হচ্ছিল ধুলো ঝড় শুরু হল। নিজেকে খুব উসকোখুসকো মনে হচ্ছিল। তখন আর বসন্ত ভাল লাগছিল না। সকাল তখন কটা হবে? বড়জোড় ১০টা। তার মধ্যেই ওই দু’কিলোমিটারের লম্বা বাঁশের সাঁকো ধরে যাতায়াত শুরু হয়েছে। লম্বা লাইন। কেউ যাচ্ছে, তো কেউ আসছে। সাঁকোর মধ্যে চেপে বসেছে ছোট ছোট চার চাকার গাড়ি। বাইক, সাইকেলের তো দীর্ঘলাইন। ধুলোঝড় তাদের যেন সয়ে গিয়েছে। আমি অবশ্য অসুবিধে অনুভব করছিলাম। চোখে রোদচশমা ছিল। ব্যাগের ভিতরে একটা ‘মাস্ক’ রেখেছিলাম। সেটি পরে নিলাম। যাতে ওই ধুলো আমার নাকের ভিতরে না পৌঁছয়। আসলে স্কুটারে চেপে খবর সংগ্রহ করতে বেরিয়ে পড়ি প্রায় নিত্যদিন। এই বসন্ত যেমন নতুন পাতা, নতুন কুঁড়ি নিয়ে আসে, মন কেমন করা হাওয়া যেমন অনেক দূর কোনও নদীর ধারে টেনে নিয়ে যায়, তেমনই ওই ধুলো উড়িয়ে চোখ-মুখ অন্ধকারও করে দেয়। নিঃশ্বাস নেওয়া যেন কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আর যাই হোক বসন্তকালে ওই জিনিসগুলি আমার সঙ্গী।
কিন্তু ওই সাঁকো পথ ধরে যাঁরা আসছেন তাঁদের অধিকাংশেরই সে রকম কিছু নেই। হাসপাতালে যাবেন বলে কয়েক মাসের এক শিশু কোলে মা হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর মাথায় একখানা ছাতাও নেই। সাইকেলে তামাকের বোঝা চাপিয়ে রফিকুল মহকুমা বাজারের পথে রওনা হয়েছেন, তাঁর পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। ধুতি ও পায়জামা পড়া মন্টু দ্রুত গতিতে হেঁটে চলছেন ও পারের বাস ধরবেন বলে। তাঁকে একটু আদালতে যেতে হবে। একটা মামলার তারিখ রয়েছে। বালুপথে দু’কিলোমিটারেরও বেশি হাঁটতে হাঁটতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ঘাম ঝরে পড়ছে। তবু তাঁর হাঁটা থামছে না। গাছের ছায়ায় খানিক বিশ্রামের সময়ও যে তখন নেই। ১০টা বাজতে চলেছে। ১১টার মধ্যে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। না হলে হতে পারে বিপদও।
মন্টুদের এই হাঁটা আজ থেকে নয়। প্রজম্নের পর প্রজন্ম ধরে তাঁরা হেঁটে চলেছেন। স্বাধীনতা এসেছে। রাজশাসনের অবসান হয়েছে। কংগ্রেস এসেছে। ’৭২-এর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছে। কমল গুহের উত্থান হয়েছে। বামেরা এসেছে। কমলবাবু মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। নন্দীগ্রাম। সিঙ্গুর। তৃণমূল সরকার এসেছে। পার্ক স্ট্রিট। কামদুনি। উদয়ন গুহ বামফ্রন্ট ছেড়ে, ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে শাসক দলে যোগ দিয়েছেন। মন্টুদের হাঁটা থামেনি। থামারও কথা নয়। বিশাল সিঙ্গিমারি নদী পার হয়ে মন্টুদের বাড়ি। বিশাল বলতে পাশাপাশি প্রায় তিন কিলোমিটার। বর্ষার সময় পুরো পথেই জল থাকে। তখন ভুটভুটি চলে। এক ভুটভুটিতে প্রায় একশো জন। ভগবানের নামে জপ চলতে থাকে। কখনও কখনও নদী আবার গর্জে ওঠে। জলের তুমুল গর্জন। কেউ আর ঝুঁকি নিতে চায় না। বন্ধ হয়ে যায় ভুটভুটি চলাচল। তখন মন্টুরা নদীর পাড়ে বসে থাকেন। ও পার থেকে এ পার দেখেন তাঁরা। দূরদৃষ্টি কখনও ক্ষীণ হয়ে আসে। চোখের কোণায় জমা হওয়া বিন্দু বিন্দু জলে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়। চোখ চলে যায় আকাশের দিকে। অন্ধকারেও আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে মন্টু। বর্ষা শেষ হতেই তোড়জোড় শুরু হয় বাঁশের সাঁকো তৈরির। সেই সময় নদী কত খণ্ডে যে বিভক্ত হয়ে পড়ে! কোথাও হাঁটু জল। কোথাও কোমর জল। বাকি পথে বালির চর। প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তায় বাঁশের সাঁকো তৈরি হয়। বাকি পথে বালু থাকে।
ওই পথ ধরে এগোতে থাকলাম। রোদ প্রায় মাথার উপরে চলে এসেছে। ছাতা নিয়ে যাওয়া হয়নি। ও পারে গিয়ে গ্রামের কিছু বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলব ভাবছি। একটু জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করলাম। পথ তো আর শেষ হয় না। বার বার যেন আটকে যাচ্ছে। একটু হাঁসফাঁস করতে লাগলাম। কোথাও একটু ছাউনি নেই। কোথাও কোনও গাছও নেই। এই নদীপথে সে সব থাকার কথা নয়। মাঝরাস্তায় কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই সময় এক জন পিছন থেকে খানিকটা জোরে হেঁটে এসেই আমার মাথায় একটা ছাতা ধরলেন। রঞ্জিত বর্মন। বাড়ি ও পারের গ্রামে। কায়েতের বাড়ি। বললেন, “বাবু কোটে যাইবেন?” একটু থেমে গিয়েছিলাম। বললাম, “ধন্যবাদ। এই একটু আপনাদের খোঁজ নিতে এলাম।” দু’জনে মিলে হাঁটছি।
জিগ্যেস করলাম, ‘‘কেমন আছেন?’’ যেন আগুনে ঘি পড়ল।
‘‘কী করি ভাল থাকি বাবু। সেতুখান হইল না। তামাক চাষ করিয়া তেমন লাভ আর হয় না। যাতায়াতেই সব শ্যাষ হয়া যায়। ভোটের সময় ভোট চায়। কাও হামার কথা ভাবে না। কত কষ্ট নিয়া যে আছি।” হাঁটতে হাঁটতে যেখানে পৌঁছলাম সেখানে ছোটমতো একটা ঘর। সামনে বাঁশের লাঠি দিয়ে গেট তৈরি করা। আসলে বাঁশের সাঁকো তৈরির জন্য লিজ দেওয়া হয়। যাঁরা লিজ নেন তাঁরা গেট তৈরি করে বাসিন্দাদের কাছ থেকে টাকা তোলেন। পাঁচ টাকা থেকে ৪০ টাকা (বাসিন্দা, বাইক, চারচাকার গাড়ি)। সেই বালুপথও হেঁটে যেতে টাকা দিতে হয় তাঁদের। প্রতি দিন যে কত টাকা ওঠে তাঁর হিসেব জানা নেই বাসিন্দাদের। বালুপথ শেষ হতেই নদীর ধারে একটি জায়গায় দাড়ালাম। রঞ্জিতবাবুর ডাকে তখন অনেক লোক ঘিরে ধরেছে। একের পর এক অসুবিধের কথা বলে গেলেন তাঁরা। প্রশাসনিক অফিস থেকে, হাসপাতাল, কলেজ, কৃষিজ পণ্য বিক্রি সব কিছুতেই সমস্যা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তাঁদের। কথা বলতে বলতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।
তখন দিনহাটা থেকে সিতাই যাওয়ার রাস্তায় সিঙ্গিমারি নদীর বালুচরে সূর্যের ছটা পড়েছে। চিকচিক করে উঠছে চার দিক। হাঁফ ছেড়ে কয়েক জন বললেন, “ওই দেখুন আমাদের স্বপ্ন।” দূরের আর একটি ঘাট দেখালেন তাঁরা। ওই ঘাটের নাম সাগরদিঘি। সেখানে গোটা নদীপথে বড় বড় সিমেন্টের পিলার তৈরির কাজ চলছে। রঞ্জিতবাবুরা বললেন, “পাঁচ বছর হয়ে গেল। ওই সেতুর কাজ চলছে। আরও দুই বছর লাগবে জানিয়েছেন। সেতু হলে আমাদের দুঃখের অনেকটাই শেষ হয়।”
পড়ন্ত বিকেলে সাগরদিঘির ঘাট ধরেই ফিরতে শুরু করলাম। সেতুর কাজ দেখে মনে মনে খুব খুশি হতে লাগলাম। আসলে এত দুঃখের কথা শুনে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। বিধানসভা ভোটে সিতাইয়ে সব থেকে বড় ইস্যু এই সেতু। শাসকদলের প্রার্থী জগদীশ বসুনিয়া থেকে শুরু করে জোট প্রার্থী কংগ্রেসের বিদায়ী বিধায়ক কেশব রায়— সবাই ওই সেতু তৈরি শুরুর কৃতিত্ব নিতে উঠেপড়ে প্রচার করছেন। বিজেপি প্রার্থী ভবেন রায়ও বলছেন ওই সেতুর কথা। সে সবের খোঁজ নিতেই এ দিন সকাল সকাল পৌঁছই গ্রামে। আর যখন ফিরছি মনে হচ্ছে, কৃতিত্ব নিয়ে কে কী বলছেন তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। কিন্তু বুঝলাম, দ্রুত ওই সেতু চালু হোক, এমন আর্জিই যেন খেতখামার, মাঠে-ঘাটে-পুকুরে ছড়িয়ে রয়েছে।