Nandigram

এক পিঠে মুখ্যমন্ত্রী, অন্য পিঠে বিরোধী দলনেতা, নন্দীগ্রামের হাতে ‘শোলে’র মুদ্রা, দু’দিকেই ‘হেড’

রসিকজন মিল পাচ্ছেন ‘শোলে’ সিনেমার সঙ্গে। ‘জয়’ অমিতাভ বচ্চন যে মুদ্রা নিয়ে টস করে সিদ্ধান্ত নিতেন, তার দু’পিঠেই ‘হেড’।

Advertisement

সুমন মণ্ডল 

নন্দীগ্রাম শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২১ ২০:০৩
Share:

নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী দলনেতা বিজেপি প্রার্থী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

মুদ্রা যে দিকেই পড়ুক। জিতছে নন্দীগ্রাম। কারণ, পূর্ব মেদিনীপুরের এই কেন্দ্রের প্রার্থী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। যিনি অল্পের জন্য হেরে গিয়েছেন। আর জয়ী প্রার্থী রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। একপিঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যপিঠে শুভেন্দু অধিকারী। মুদ্রার নাম নন্দীগ্রাম।

Advertisement

রসিকজন মিল পাচ্ছেন রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’ সিনেমার সঙ্গে। ‘জয়’ অমিতাভ বচ্চন যে মুদ্রা নিয়ে বার বার টস করে সিদ্ধান্ত নিতেন এবং ‘বীরু’ ধর্মেন্দ্রকে হারিয়ে জিততেন, তার দু’পিঠেই ‘হেড’। সাধারণ মুদ্রার মতো একপিঠে ‘হেড’ এবং অন্যপিঠে ‘টেল’ নয়। যেমন জিতছেন নন্দীগ্রামের মানুষ। জোর টক্করে শুভেন্দুর কাছে নামমাত্র ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন মমতা। কিন্তু গোটা রাজ্যে বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়ে এবং একার ক্ষমতায় অদ্যাবধি সর্বাধিক আসন পেয়ে তৃতীয়বার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী। হেরে গেলেও নন্দীগ্রামের উপর তাঁ ‘বিশেষ নজর’ থাকবে বলেই ধরে নিচ্ছে তৃণমূলের অন্দরমহল। পক্ষান্তরে, সামান্য ব্যবধানে জয়ী শুভেন্দু চেষ্টা করবেন নন্দীগ্রামে নিজের ভিত আরও পোক্ত করতে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা— উভয়েরই ‘পাখির চোখ’ হতে পারে নন্দীগ্রাম। ‘শোলে’র মুদ্রা। দু’পিঠেই ‘হেড’।

২০০৭ সালে গোটা দেশের পাশাপাশিই এসইজেড বিরোধী আন্দোলনের ফলে কিছুটা আন্তর্জাতিক পরিচিতিও পেয়েছিল নন্দীগ্রাম। তার ১৪ বছরের মাথায় মমতা-শুভেন্দুর দ্বৈরথ ঘিরে ফের শিরোনামে চলে আসে ওই বিধানসভা কেন্দ্র। কিন্তু ভোট-পরবর্তী সময়ে নন্দীগ্রামের যা রাজনৈতিক সমীকরণ তা সাম্প্রতিক অতীতে বিরল।

Advertisement

‘শোলে’ ছায়াছবিতে টস করার সেই মুহূর্ত।

নন্দীগ্রাম ১ ব্লকের তেখালির বাসিন্দা পেশায় স্কুলশিক্ষক রাজকুমার জানার কথায়, ‘‘এখানকার মানুষের অদম্য লড়াইয়ের মানসিকতাই দুই জোরাল প্রার্থীকে নন্দীগ্রামের ময়দানে নামতে বাধ্য করেছে।’’ ২০০৭ সালের জমি আন্দোলনের সময়কার স্মৃতি আউড়ে রাজকুমার বলছেন, ‘‘এখানকার মানুষ সাদাসিধে। কিন্তু জেদ চেপে গেলে তাঁরা কাউকেই ছেড়ে কথা বলেন না। জমি আন্দোলনের সময় গোলাগুলির সামনে দাঁড়িয়ে, বহু প্রাণের বিনিময়েও হার মানেননি এখানকার মানুষ। এ বারও তাঁরা হার মানলেন না। দুই প্রার্থীই মর্যাদার আসন পেলেন।’’ স্কুলশিক্ষকের ব্যাখ্যা, ‘‘নন্দীগ্রামের কেউই মুখ্যমন্ত্রী অথবা শুভেন্দুকে অপছন্দ করেন না। তবে এ বারের ভোটে দু’পক্ষই এককাট্টা হয়ে গিয়েছিল।’’

নন্দীগ্রামের কালীচরণপুরের বাসিন্দা প্রাক্তন সরকারি কর্মী বিনয় দাসের কথায়, ‘‘এক সময় নন্দীগ্রাম ছিল চূড়ান্ত অবহেলিত। পরবর্তী কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর প্রচেষ্টাতেই নন্দীগ্রাম আলোর পথ দেখেছিল। দু’জনের কী মতবিরোধ হল আমরা বুঝি না। ওঁদের লড়াই এবার ভোটের ময়দানে দেখেছেন নন্দীগ্রামের মানুষ। আশা করছি, মুখ্যমন্ত্রী হেরে গেলেও মুখ ফিরিয়ে থাকবেন না।’’

নন্দীগ্রামের ভোটের সময় মমতা ছিলেন নন্দীগ্রাম ২ ব্লকের রেয়াপাড়া শিবমন্দির এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দা উমাকান্ত দাসের আবার অভিমত, ‘‘গত ১০ বছর এখানে একচেটিয়া শাসন করেছিলেন শুভেন্দু। এ বার তাঁকে হারানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন মমতা।’’ উমাকান্তের আক্ষেপ, ‘‘মমতা জিতলে প্রতিশ্রুতি মতো হলদিয়া-নন্দীগ্রামের মাঝে একটা সেতু নিশ্চয়ই হত। উনি হেরে গেলেও আশা করি সেতুটা হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নন্দীগ্রামবাসীসার্বিক উন্নয়ন চায়। নন্দীগ্রামের এক জন প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী এবং আরেক জন বিরোধী দলনেতা। অতএব এই কেন্দ্রের সার্বিক উন্নয়ন হবে এটাই আশা।’’

২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর গোকুলনগর থেকে নিখোঁজ হন প্রাক্তন সেনাকর্মী আদিত্য বেরা। তাঁর নাতি অমিত বেরা এখন যুবক। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় দাদুকে যখন খুন করা হয়, তখন তাঁর পেনশনের টাকায় সংসার চলত। সেই সঙ্গে একটা গাড়িও ভাড়ায় খাটাতেন বাবা। তৎকালীন শাসক সিপিএমের দুষ্কৃতীরা সেই গাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা সর্বস্বান্ত হয়েছিলাম।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নন্দীগ্রাম বরাবরই উপেক্ষিত। এখানে শিল্প দরকার হলেও সিপিএম সরকারের ভুল নীতির ফলে তা ভেস্তে গেল। এখন যদি মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা দু’জনেই নন্দীগ্রামের দিকে নজর দেন।’’

নির্বাচন কমিশনের খাতায় যে ফলাফলই লেখা হোক না কেন, টানটান রাজনৈতিক বিক্রিয়ার পরেও নন্দীগ্রামই ‘ধ্রুবক’। দু’দিকেই ‘হেড’। ‘শোলে’র মুদ্রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন