২০১১-২০২১। প্রত্যাশা কতটা পূরণ হল সামাজিক সুরক্ষায়?
mamata banerjee

সুরক্ষায় নজর, উত্তরণ কোথায়

এই সব অনুদান প্রকল্পে নাম লেখানোয় দলাদলি, দুর্নীতির আঁশগন্ধ অত লাগেনি, যতটা লেগেছে রোজগার সুরক্ষা, অর্থাৎ একশো দিনের কাজের প্রকল্পে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৫৬
Share:

ফাইল চিত্র।

হাসির আলো। ঐক্যশ্রী। স্নেহের পরশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বিভিন্ন নামে বহু প্রকল্প চালু করেছেন। প্রথমটি দেয় বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, দ্বিতীয়টি সংখ্যালঘু ছাত্রবৃত্তি, তৃতীয়টি পরিযায়ী শ্রমিকের সহায়তা। বেকারত্ব, প্রতিবন্ধকতা, বার্ধক্য, অতি অল্প রোজগার— এ সবের জন্য যাতে জীবনের একান্ত জরুরি চাহিদা (খাদ্য, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা) অপূর্ণ না থাকে, তার ব্যবস্থাই সামাজিক সুরক্ষা। মমতা দরিদ্রকে অনুদানের প্রকল্প বাড়িয়েছেন, টাকার অঙ্কও। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দু’টি প্রধান নালিশ। এক, তিনি কর্মী-শ্রমিকদের প্রাপ্য অর্থ, সুবিধা সুরক্ষিত করেননি। আর দুই, প্রচুর অপ্রয়োজনীয়, এমনকি, আপত্তিকর অনুদান দিয়ে চলেছেন। সামাজিক সুরক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সমর্থনের সুরক্ষা।

Advertisement


বাংলার ঠিকা শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপন্নতা স্পষ্ট করেছে অতিমারি। প্রশ্ন অবশ্য তার আগেই উঠেছিল। যথেষ্ট কাজ তৈরিতে রাজ্য ব্যর্থ, এই অভিযোগ এড়াতে রাজ্য সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের তথ্যভাণ্ডার তৈরিতে গড়িমসি করেছে বহু দিন। বারবার ভিন‌্ রাজ্যে শ্রমিক নিহত হয়েছেন, আর রাজ্য ঘোষণা করেছে, নথিভুক্ত করা হবে পরিযায়ী শ্রমিকদের। তা হয়নি। তাই অতিমারিতে দশ লক্ষেরও বেশি বাঙালি শ্রমিক বকেয়া টাকা হারিয়ে, প্রাণটুকু নিয়ে রাজ্যে ফিরেছেন। যে রাজ্য তাঁদের অরক্ষিত, ঠিকাদার-কবলিত করে রেখেছিল। সরকারের দাবি, লকডাউন-উত্তর পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘তথ্যভাণ্ডার’ তৈরি হয়েছে। তাতে ১৫ লক্ষ শ্রমিকের নাম রয়েছে, যাঁদের দক্ষতা অনুসারে (১১ লক্ষই অদক্ষ) প্রশিক্ষণ বা রোজগারের ব্যবস্থা হবে। আপাতত এটা আশ্বাসমাত্র। যা জানা আছে তা হল, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের জন্য নানা ভাতা চালু করেছেন মমতা। কিন্তু তাঁর শ্রমের মূল্য, প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি। তাঁর সরকারের আইন, প্রশাসন, রাজনীতি — কোনওটাই ওই শ্রমিকের সুরক্ষা বাড়ায়নি।


সংগঠিত ক্ষেত্রেও সেই অ-পরিবর্তনের ছবি। কেবল চটকলগুলির অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিকের গ্র্যাচুইটি বাকি, যার অঙ্ক হাজার কোটি টাকার উপর। নানা শিল্পে বহু নিয়োগকর্তা প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই-এ প্রদেয় টাকা জমা দিচ্ছেন না। সরকারি প্রকল্পে কর্মীদের দশাও তথৈবচ। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল, পুরস্বাস্থ্য কর্মী, শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন কর্মীরা ন্যূনতম দৈনিক মজুরির হারে বেতন পান না। তাই যখন সরকারি অনুদান পায় ক্লাব (এখনও অবধি প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা), পুজো কমিটি, ইমাম, পুরোহিত, তখন প্রশ্ন ওঠে — এ কেমন নীতি?

Advertisement

কর্মী তার হকের পাওনা পেল কি না, তা দেখার চাইতে মমতা বেশি আগ্রহী বাঁচার সম্বলটুকু পৌঁছে দিতে। খালি পেট, খালি হাত যাতে না থাকে, তার জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির শর্তের ফাঁস আলগা করছেন তিনি। সেগুলো ক্রমশ সর্বজনীন হয়ে উঠছে। ‘খাদ্যসাথী’ থেকে তার শুরু। বৃদ্ধ, বিধবা, প্রতিবন্ধীদের ভাতা দিতে কেন্দ্র অকথিত ‘কোটা’ ব্যবস্থা চালাচ্ছিল। মমতা সব যোগ্য ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির দিকে এগোচ্ছেন। ‘কন্যাশ্রী’তেও পারিবারিক আয়ের ঊর্ধ্বসীমা কার্যত উঠে গিয়েছে।

এই সব অনুদান প্রকল্পে নাম লেখানোয় দলাদলি, দুর্নীতির আঁশগন্ধ অত লাগেনি, যতটা লেগেছে রোজগার সুরক্ষা, অর্থাৎ একশো দিনের কাজের প্রকল্পে। শেষ লোকসভা নির্বাচনের পর পঞ্চায়েতের নেতাদের ‘কাটমানি’ ফেরত দিতে বলেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তবে বাম জমানার শেষে বছরে গড়ে ১৫ কোটি শ্রমদিবস মিলত আর এখন ৩৮-৩৯ কোটি শ্রম দিবস মিলছে। মেয়েদের অংশগ্রহণ ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ৪৮ শতাংশ। রেশন ব্যবস্থার প্রসার, একশো দিনের কাজে বৃদ্ধি, পেনশন এবং ভাতার অধিক গ্রাহক, এ সব চূড়ান্ত দারিদ্র থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু শ্রমের অবমূল্যায়ন না ঘুচলে দারিদ্রসীমা তারা পার হবে কি? সারাজীবন কি সরকারের প্রসন্নতা-পিয়াসী হয়ে থাকবে মানুষ?

এক কথায়, সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে মমতা নেতাসুলভ নন, দিদিসুলভ। হকার থেকে গৃহপরিচারিকা, যে কেউ ন্যায্য অধিকার দাবি করলে রুষ্ট হন। আবার তুষ্ট হলে মেনে নেন অন্যায় আবদারও। দরিদ্রের সব চাহিদার মুখে দাঁড়িয়ে তাই তাঁর দলের পরামর্শ, ‘দিদিকে বলো।’ (আগামিকাল পরিবেশ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement