সিপিএম প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের দেখা যখন মিলল, সভায় শ্রোতা তখন সব মিলিয়ে ষাটও হবে না।
West Bengal Assembly Election 2021

Bengal Poll: সঙ্গী টোটো আর জনাদশেক কমরেড, নন্দী-মঙ্গল কাব্যে উপেক্ষিতা মীনাক্ষী

দাউদপুরের ভাটপুকুর বাজারের ছোট্ট মাঠে সংযুক্ত মোর্চার সিপিএম প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের দেখা যখন মিলল, সভায় শ্রোতা তখন ষাটও হবে না।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

নন্দীগ্রাম শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২১ ২০:৫২
Share:

মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়।

প্রায় একাই এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে একটা টোটো আর সব মিলিয়ে জনা দশেক কর্মী-সমর্থক।

Advertisement

নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তায় কিলোমিটার তিনেক পেরিয়ে দাউদপুরের ভাটপুকুর বাজারের ছোট্ট মাঠে সংযুক্ত মোর্চার সিপিএম প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের দেখা যখন মিলল, সভায় শ্রোতা তখন সব মিলিয়ে ষাটও হবে না। কিন্তু রোদে পোড়া শনিবারের বারবেলায় সেই হাতে গোনা জনতাকেই মীনাক্ষী বোঝাচ্ছিলেন, তিনি শুধুমাত্র এক জন প্রার্থী। এই ভোটে জেতা দরকার নন্দীগ্রামের কৃষকের। এখানকার চাকরিপ্রার্থী যুবকের। দু’বেলার খাবার নিশ্চিত করতে-চাওয়া মানুষের। সামনের জনতা সেই বোঝানোয় সাড়া দিয়ে হাততালিও দিচ্ছিল। গুটিকয়েক মাইক আর সাউন্ড বক্সে তাঁর কণ্ঠস্বরকে মাঝেমাঝে ছাপিয়েও যাচ্ছে সেই তালির আওয়াজ।

তিনি প্রার্থী। অথচ তাঁর নামে কোনও পোস্টার, ব্যানার বা দেওয়াল লিখন নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ড পৌঁছনো ইস্তক চোখে পড়েনি। বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখে নজরে পড়ে ফুট দুয়েক চওড়া একটা পতাকা। খেজুর গাছে বাঁধা। তার পর আবার খাঁ-খাঁ। ভাটপুকুর বাজারের আগে ছোট ধানক্ষেতের মাঝে গুটিকয়েক পতাকা। আবার যে কে সেই। সভায় লোকও সেই পতাকা-সম, হাতে গোনা।

Advertisement

তবে কি তিনি নন্দী-মঙ্গল কাব্যে উপেক্ষিতা? মীনাক্ষী বলছেন, ‘‘নন্দীগ্রামে মানুষকে ভয় দেখানো হয়। নন্দীগ্রামের মাটিতে শ’দুয়েককে মনে করতে হবে ২ লাখ। ও ভাবে দেখতেই হবে। আমাদের পতাকা লাগানো হলে খুলে দেয়। তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষই। তা হলে কে কার বন্ধু ভাবুন! আর আমাকে উপেক্ষা করার কী আছে! আমি তো প্রার্থী মাত্র। এ লড়াই তো নন্দীগ্রামবাসীকে জিততে হবে। তৃণমূল এবং বিজেপি যে নন্দীগ্রাম এবং গোটা রাজ্যের জন্যই ভয়ানক, সেটা ওঁরা বুঝছেন।’’

টপ টপ করে ঘাম ঝরছে কপাল-গলায়। কিন্তু ভাষণে এতটাই মগ্ন, সে সব মোছার ভাবনাই নেই।

চড়া রোদ্দুরে প্রায় ফাঁকা মাঠে মীনাক্ষী যখন ভাষণ দিচ্ছেন, মাথায় সাদা রঙের গামছাটা ভাঁজ করে ফেলা। রানি রঙের কুর্তা, সাদা সালোয়ার ও উড়নির উপর লাল রঙের দলীয় উত্তরীয়। টপ টপ করে ঘাম ঝরছে কপাল-গলায়। কিন্তু ভাষণে এতটাই মগ্ন, সে সব মোছার ভাবনাই নেই। সভা শেষে জিজ্ঞাসা করা গেল, দিনে ক’টা সভা করছেন? গামছায় মুখ মুছতে মুছতে জবাব, ‘‘এখনও পর্যন্ত এক দিনে ১৮টা সভা করেছি। ওটাই সর্বোচ্চ।’’ কত লোক হচ্ছে তাঁর পথসভায়? প্রচারে? সর্বোচ্চ? সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ৪০০ জন। জানালেন মীনাক্ষী নিজেই। তার পর নিজেই বললেন, ‘‘আর সবচেয়ে কম? চার জন।’’

১০ মার্চ নন্দীগ্রামের প্রার্থিতালিকা ঘোষিত হয়। ১১ তারিখ সকালেই ৩৭ বছরের মীনাক্ষী পৌঁছে যান নন্দীগ্রাম। তার পর আর বর্ধমানের বাড়িতে ফেরা হয়নি। নন্দীগ্রামে একটা বাড়িও ভাড়া নিয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন এই নন্দীগ্রামেরই রেয়াপাড়ায়। মীনাক্ষী, তিনিও? চোখে এ বার প্রতিবাদের ঝলকানি: ‘‘হ্যাঁ, নিতে হয়েছে। কারণ, আমাদের পার্টি অফিসগুলো তো সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওগুলো অক্ষত থাকলে ওখানেই উঠতাম। অনেকগুলো আবার খুলতেও দিচ্ছে না।’’ ছোট্ট বোতলের ওআরএসে কয়েকটা চুমুক।

ভাষণের সময়েই নজরে এসেছিল, মীনাক্ষীর বাঁ হাতের অনামিকায় একটা ‘সাপোর্ট’ লাগানো। ওআরএসে চুমুক দেওয়ার সময় জানালেন, সম্প্রতি নবান্ন অভিযানের সময় পুলিশের লাঠিতে তাঁর ওই আঙুলে ভয়ানক চোট লাগে। বেঁকে যায় আঙুল। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শে ওই ‘সাপোর্ট’। সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সভানেত্রী মীনাক্ষী। বামেদের দু’বারের নবান্ন অভিযানেই তাঁকে সামনের সারিতে দেখা গিয়েছিল। জলকামান বা লাঠিচার্জ— দুয়েরই সামনে ‘সহযোদ্ধা’দের আগলাতে দেখা গিয়েছে মীনাক্ষীকে। সে কথা মনে করাতেই বললেন, ‘‘আন্দোলনে প্রাণ চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না। আর আমাদের আন্দোলনটা একেবারেই শান্তিপূর্ণ ছিল। এখানকার মানুষও টিভি-তে সে সব দেখেছেন। এই সরকারের উপর নন্দীগ্রামবাসীর রাগ আছে।’’

নন্দীগ্রামে ২০১১-র আগে দু’বারের বিধায়ক ছিলেন সিপিআইয়ের মহম্মদ ইলিয়াস। কিন্তু মাঝপথে তাঁকে ‘স্টিং’-কাণ্ডে পদত্যাগ করতে হয়। তার পর থেকে নন্দীগ্রাম তৃণমূলের দখলে। সিপিআইয়ের অন্দরের কথা, ইলিয়াসের বড় ছেলে সাদ্দাম এই কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আসনটি সিপিএমকে ছেড়ে দেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। শোনা যায়, সাদ্দাম নাকি তাতে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। মীনাক্ষীর অবশ্য দাবি, দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে কথা হয়েছে। কোনও সমস্যা নেই। বরং গোটা নন্দীগ্রাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীতেই বিরক্ত। মীনাক্ষীর কথায়, ‘‘পকেটমার কি বাস থেকে নেমে গেলে অফিসার হয়ে যায়? না তো। ও শুধু বাসটাকে পাল্টায়, পেশা পাল্টায় না। এত দিন যিনি তৃণমূলের ছাতায় লুটেপুটে খাচ্ছিলেন, তিনি এখন অন্য একটা বড় ছাতার তলায় গিয়ে লুটেপুটে খাবেন। সেটা নন্দীগ্রামবাসীকে আমরা সকলে মিলে বোঝাচ্ছি। বলছি, সিদ্ধান্ত আপনারা নিন।’’

কিন্তু তাঁর কথা তো কেউ বলে না। দেওয়াল লিখন বলে না। পোস্টার বলে না। ফেস্টুন বলে না। পতাকা বলে না। ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত গাইছেন না তো? মীনাক্ষী বলছেন, ‘‘ভিতরটা পড়তে পারছি যে। বাইরেটা দেখে কী হবে!’’ টোটো এগিয়ে যায় সরু কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে। আর তখনই এত ক্ষণ চুপ করিয়ে রাখা এক ঝাঁক মাইক বেজে ওঠে একসঙ্গে। সিপিএমের নয়। অন্য দলের মিটিং শুরু হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন