বেলদার ডালের বড়া তাঁর চাই। সঙ্গে চাই নারায়ণগড়ও। যে কোনও মূল্যে! কিন্তু এই আবদার করতে গিয়েই শুক্রবার তাল গেল কেটে!
পশ্চিম মেদিনীপুরের পিঠোপিঠি দুই কেন্দ্র সবং আর নারায়ণগড় এ বার তৃণমূলের খাস নজরে। কারণ, মানস ভুঁইয়া ও সূর্যকান্ত মিশ্রকে হারাতে পারলে কংগ্রেস-বাম জোটকে মোক্ষম ধাক্কা দেওয়া যাবে। সবং ঘুরে যাওয়ার পরে এ দিন সেই লক্ষ্য নিয়েই নারায়ণগড়ে পা রেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুপুরে ভবানীপুরে মনোনয়ন পেশ করেই হেলিকপ্টারে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কেন্দ্রে উড়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। সভায় তখন হাল্কা ভিড়। পরে আস্তে আস্তে মাঠ ভরল।
সিপিএম রাজ্য সম্পাদককে চার্জশিট দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন মমতা। তার পর তাতে লাগল ভাবাবেগের স্পর্শ। সবার শেষে কাতর আর্জি। আর তাতেই ফল হল উল্টো!
এ দিন সভার শেষ লগ্নে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কত বড় সাহস! আমাদের সবাইকে চোর বলছে! যে লোকটা পাঁচ বছর আমাকে অপমান করেছে, কুৎসা করেছে, তাকে হারাতে হবে। নারায়ণগড়ে জিততে দেওয়া যাবে না! কী বলুন, হারাবেন তো?’’ জনতা চুপ! মুখ্যমন্ত্রী আবার বললেন, ‘‘কী জিততে দেবেন না তো?’’ এ বারও তেমন সাড়া নেই! একটু অধৈর্য হয়েই এ বার মমতা বলে ফেললেন, ‘‘কী হল? আপনারা ভোট দেবেন তো? আবার উল্টে দেবেন না তো?’’ প্রায় চাপে পড়েই ‘না’ বলতে বাধ্য হল জনতা!
নারায়ণগড়ের সভা সেরে মমতা চলে যান আসানসোলে। কিন্তু তাঁর কপ্টার উড়ে যাওয়ার পরেও মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল গুঞ্জন! জোটের দাপটে তা হলে কি এখন আশঙ্কা তাড়া করে বেড়াচ্ছে তৃণমূল নেত্রীকে? গলা উঁচিয়ে প্রচারের পরেও কি মনে ভয় থেকে যাচ্ছে— লোকে মানছে তো! সারদা, নারদ থেকে উড়ালপুল বিপর্যয়, একের পর এক ধাক্কায় গোটা দল দিশাহারা। একান্ত আলোচনায় সে কথা কবুল করছেন তৃণমূল নেতারাই। তাঁদের একাংশের মতে, সেই বেহাল দশারই প্রতিফলন ঘটছে দলনেত্রীর বক্তৃতায়। কোথায় আক্রমণ, কোথায় রক্ষণ, সবই যেন তাল পাকিয়ে যাচ্ছে তাঁর।
কুলটিতে দু’দিন আগে ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে জনতাকে বলেছিলেন, ‘ভুল বুঝবেন না। আপনাদের শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ, দোয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না।’ তার পর এ দিন শুরু করেছিলেন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। এক দিকে নেতাই ও নন্দীগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেওয়া। অন্য দিকে নারায়ণগড়ের মাটিতে নিমাই সিংহ, দমনি হাঁসদা, চিত্ত পাল, শম্ভু হাঁসদা, গঙ্গাধর খাটুয়া-সহ বহু মানুষ কাদের হাতে খুন হয়েছিল, তার জবাব চাওয়া। চ্যালেঞ্জের সুরেই মমতা বলেন, “আমি চার্জশিট দেখালাম। আগে নারায়ণগড়ের মানুষকে জবাব দিয়ে যান! এত খুন করে গণতন্ত্রের কথা বলেন কী ভাবে? আমরা আছি বলে আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছি। আপনারা সেটা দেননি।”
এর পরে প্রতিশ্রুতির টোপ। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, “আপনারা প্রদ্যোৎ ঘোষকে (তৃণমূল প্রার্থী ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি) জয়ী করুন। যা চাই, তা-ই করে দেব নারায়ণগড়ে!’’ সেই সঙ্গে ঘুরিয়ে একটু হুঁশিয়ারি। “সূর্যকান্তবাবুকে ভোট দেবেন? ওঁর স্ত্রীর নামে একটা বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। আমরা চাইলে গ্রেফতার করতে পারতাম। কিন্তু আমরা কংগ্রেস, বিজেপির মতো নই। তবে সৌজন্য দেখিয়েছি বলে ভাববেন না, যা ইচ্ছে তা-ই করবেন!”
কিন্তু প্রতিশ্রুতি আর আক্রমণে কাজ হবে কি না বুঝতে না পেরেই যেন সব শেষে নিখাদ আর্জি। “আপনাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, সূর্যকান্ত মিশ্রকে পরাজিত করুন! যদি সূর্যবাবুকে হারাতে পারেন, তবে প্রথম সভা করব নারায়ণগড়ে। আমি এখানকার ডালের বড়া ভালবাসি। সে দিন কিন্তু বেলদার ডালের বড়া খাওয়াতে হবে!”
আরও পড়ুন:
বিষ দাঁত ভেঙে দিন, কড়া বার্তা সূর্যের
মুখ্যমন্ত্রীর আবদার শুনে সূর্যবাবুকে অবশ্য বিশেষ বিচলিত দেখায়নি। এক সভা থেকে অন্য সভায় দৌড়নোর ফাঁকে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন। এর কোনও জবাব হয় না।’’ পরে ছোট্ট সংযোজন, ‘‘ডালের বড়ার জন্য নারায়ণগড় আসতে পারবেন কি না, জানি না। তবে ১৯ মে-র পরে ওঁকে রাজভবন যেতে হবে ইস্তফা দিতে!’’
এ দিন আসানসোলে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর বৃহস্পতিবারের বক্তৃতার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মমতা। তবে সারদা-নারদা বা উড়ালপুল-সিন্ডিকেট— কোনও প্রসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের ধারপাশ মাড়াননি। মঞ্চের এ মাথা থেকে ও মাথা করতে করতে বলেছেন, ‘‘কত বড় সাহস, আমাদের বলছে মওত, টেরর, করাপশন! আমি যদি বলি, বিজেপি মানে ‘ভয়ানক জালি পার্টি’? এটা কি ভাল হবে? যা-ই হোক, এটা প্রত্যাহার করলাম!’’ কেন্দ্র রাজ্যের টাকা কেটে নিয়ে যাচ্ছে আর প্রধানমন্ত্রী জ্ঞান দিচ্ছেন, সেই ভাঙা রেকর্ড ফের বাজিয়ে মমতার মন্তব্য ‘‘আমরা কাজ করি না, উন্নয়ন করি না? তোমার চোখে ছানি পড়েছে? উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছ না?’’
নারায়ণগড় আর আসানসোল, দু’জায়গাতেই দিদির ভাষণ শুনে হতাশ আমজনতা। দুই সভা শেষেই তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন উঠল: দু’বছর আগের সেই ঝাঁঝ কোথায়! এ তো একেবারে মিইয়ে যাওয়া পাঁপড়।
উল্টে যাওয়ার আশঙ্কাতেই কি?