Exclusive Interview Of Promita Bhowmik

পুরুষের বন্ধ্যাত্ব আজও সমাজ আড়াল করার চেষ্টা করে, লড়তে হয় শুধুই ‘অহনা’দের

“কী ভাষায় একজন বর্ষীয়ান শিল্পীর কথার বিরোধিতা করবেন, সেই বিষয়ে প্রত্যেকের যত্নবান হওয়া দরকার”, মমতাশঙ্কর প্রসঙ্গে প্রমিতা।

Advertisement

উপালি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৪
Share:

পরিচালক প্রমিতা ভৌমিক নারীবাদে বিশ্বাসী? ছবি: সংগৃহীত।

প্রথম বড় ছবি। প্রথমেই একাধারে প্রযোজক-পরিচালক-কাহিনিকার! এবং ‘অহনা’ বানাতে গিয়ে একের পর এক হোঁচট। নারীবাদ না পুরুষতন্ত্র, ৫ সেপ্টেম্বর ছবিমুক্তির পরে জিতবে কে? ফিরে দেখায় প্রমিতা ভৌমিক।

Advertisement

প্রশ্ন: নারীকেন্দ্রিক ছবির প্রযোজক-পরিচালক-কাহিনিকার একজন মহিলা। প্রমিতা কী কী দেখলেন?

প্রমিতা: প্রথম বড় ছবি। প্রযোজনার দায়িত্বও সামলাতে হবে, ভাবিনি। কারণ, অনেক টাকাপয়সার ব্যাপার। সেটা বড্ড ঝুঁকির। অন্য ভাবে অর্থ জোগানের তাই চেষ্টা করেছি। প্রযোজক খুঁজেছি। এ দিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। ফলে, নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হল। নিজের জমানো অর্থ আর খুব কাছের বন্ধুদের আর্থিক সহযোগিতা— এ সব নিয়েই কাজ শুরু করলাম। এটা বলতে পারি, কখনও থামিনি। যখন যেমন অর্থ এসেছে, তখন সে ভাবে শুটিং করেছি। এ ভাবেই একদিন ছবি তৈরির কাজ শেষ হল। বাধা বলতে প্রধানত আর্থিক। আর পাঁচ-সাত জনের কাজ একা করতে হয়েছে। শিল্পনির্দেশক থেকে এগজিকিউটিভ প্রোডিউসার— সব একার ঘাড়ে। বলতে পারেন, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ।

Advertisement

প্রশ্ন: দেখে অন্যরা অবাক হতেন?

প্রমিতা: (হেসে ফেলে) হতেন। অবাক হয়ে বলতেন, “আপনি ছবির পরিচালক। আপনিই আবার রসিদে সই করাচ্ছেন!” কী করব? আমার তো কোনও প্রথম সারির প্রযোজনা সংস্থা নেই। স্বাধীন ভাবে কাজ করি। ফলে, প্রচুর লোক নেই। আমিই সব। এমনকি, ছবি পরিবেশনার দিকটাও দেখতে হচ্ছে।

প্রশ্ন: অথচ এর আগে আপনার ছোট ছবি আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মানিত, খ্যাতনামী অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করেছেন।

প্রমিতা: একেবারেই তা-ই। সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে পাশে পেয়েছিলাম তখন। প্রত্যেকে আমার কাজের প্রশংসা করেছিলেন। দেশের বাইরের ছবিটাও একই। অর্থাৎ, প্রথম বড় ছবি হলেও নতুন কাজ করছি— এমনটা নয়। হয়তো নারীকেন্দ্রিক ছবি বলেই প্রযোজক পেতে সমস্যা হল। কারণ, অনেকেই এই ধরনের ছবি প্রযোজনা করতে চান না। তার উপরে মহিলা পরিচালক! এটা এখনও ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে। প্রশ্ন ঘোরে, ‘তুমি কি একা পারবে?’ একজন পুরুষ পারলেও একজন নারী কি একা সব পারবে— এই মানসিকতা এখনও বেশির ভাগের মনে। এমনও জানতে চাওয়া হয়েছে, আমার কি সঙ্গে আর কাউকে প্রয়োজন? অবাক হয়েছি, কেন আর কাউকে লাগবে আমার!

প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কি কিছুটা হলেও এই প্রশ্নের জবাব দিল?

প্রমিতা: এটা কিছুটা হলেও হয়েছে। এই যে আমি জার্মানিতে গেলাম, আমেরিকায় গেলাম— তাতে লোকে বুঝি একটু আশ্বস্ত হল। অনেকে কাজের প্রশংসাও করছেন ইদানীং। আগে দেশের অনেক চলচ্চিত্র উৎসবেও ‘অহনা’ দেখানো হয়েছিল। তখন কিন্তু কেউ পাত্তা দেননি!

‘অহনা’ ছবিতে সুদীপ্তা চক্রবর্তী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

প্রশ্ন: যতই বলি মেয়েরা স্বাধীন, আদতে কি তাই? তাই ‘অহনা’ বানাতে হল?

প্রমিতা: বলতে পারেন অনেকটাই। ছবির নায়িকার কথাই ধরুন। তার স্বামী নিজের কলেজে নারীবাদ নিয়ে পড়ায়। বাইরে সেমিনারে এই বিষয়ের উপরে বক্তব্য রাখে। সেই লোকটিরই বাড়িতে ফিরে ভিন্ন রূপ। তার সেমিনারের সময়ে স্ত্রীর গল্পপাঠের সময় হলে তাকে যেতে বাধা দেয়। নিজের বাবার চিকিৎসার ভার চাপিয়ে দেয় স্ত্রীর উপর। কারণ হিসাবে মুখের উপরে জানিয়ে দেয়, স্ত্রীর গল্পপাঠের থেকেও তার সেমিনার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটাই বাস্তব।

প্রশ্ন: সেই জন্যই বোধহয় প্রমিতাকে শুনতে হয়, তুমি একা পারবে তো?

প্রমিতা: এটা ভিতর থেকে ঠিক না হলে কিছুই শুধরোবে না। বহু যুগের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। আমরা বড়জোর শিল্পের মাধ্যমে, ছবি তৈরি করে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করতে পারি। ভিতর থেকে পরিবর্তন না হলে এই সমস্যার শেষ নেই। আমরা তাই চেষ্টা করে গেলাম। পরের প্রজন্ম হয়তো সুফল ভোগ করবে। আমি এখন এ ভাবেই ভাবতে চেষ্টা করি। বদলাতে তো সময় লাগে।

প্রশ্ন: শুধু তা-ই নয়, এখনও ‘বি এ উওম্যান’ বলা হয় না...

প্রমিতা: দেখুন, গায়ের জোরের প্রসঙ্গে বলব, শারীরিক দিক থেকে হয়তো পুরুষ এগিয়ে। কিন্তু মনের জোর নারীর বেশি। আমাদের সমাজ সেই সত্যিকে শতকের পর শতক আটকে রেখে দিয়েছে। নিজের মতো করে পিতৃতন্ত্রের ভাষা বানিয়ে নিয়েছে। মেয়েরা তাদের মতো করে সেই আগল ভাঙার চেষ্টা করছে। ‘বি এ ম্যান’-এর থেকে ‘বি এ উওম্যান’-এর দিকে যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। বদল যে হচ্ছে না তা নয়। তার ছাপ পড়ছে গল্প, কবিতা, ছায়াছবি, নাটক— সর্বত্র।

প্রশ্ন: তা হলে নিশ্চয়ই আপনি মেয়েদের ‘মাই বডি মাই চয়েজ’-এও বিশ্বাসী? কিংবা, মা না হতে চাওয়ার সিদ্ধান্তে?

মমতাশঙ্কর প্রসঙ্গে প্রমিতা ভৌমিক। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

প্রমিতা: অবশ্যই। তবে এই স্বাধীনতা নারী-পুরুষ উভয়েরই পাওয়া উচিত। কারণ, প্রত্যেকের শরীর তার নিজের। ফলে, মা বা বাবা হওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেবেন। এই স্বাধীন মনোভাব থেকেই আমার উপলব্ধি, সে ক্ষেত্রে পরকীয়া বা বহুগামিতাতেও যেন স্বচ্ছতা থাকে। একাধিক সম্পর্কে থাকতে গিয়ে কেউ যেন কাউকে না ঠকায়। যা করব সেটা যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়— ২০২৫-এ এসে এই বোধ নারী-পুরুষ উভয়ের থাকতে হবে। প্রত্যেকে নিজের পছন্দে, নিজের মতো করে, নিজের শর্তে বাঁচবে। ‘অহনা’য় এই বোধের উদ্‌যাপন আছে। আমার আগের ছোট ছবিগুলোতেও আছে।

প্রশ্ন: আপনি তো তা হলে মমতাশঙ্করের মতের বিরোধী?

প্রমিতা: (হেসে ফেলে) দেখুন, মমদির মতো শিল্পীর সমালোচনা করার সাহস বা যোগ্যতা আমার নেই। তবে একজন নারী হিসাবে আমার মত, নিজের মত জানানোর বাক্‌স্বাধীনতা দিদির আছে। একই ভাবে ওঁর বিরোধীদেরও বক্তব্য রাখার অধিকার রয়েছে। এ বার, কী ভাষায় একজন বর্ষীয়ান শিল্পীর কথার বিরোধিতা করবেন, সেই বিষয়ে প্রত্যেকের যত্নবান হওয়া দরকার। মমদি নিজের মতামত জানিয়েছেন। কাউকে জোর করে মানতে বলেননি। একটি বিষয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সুস্থ আলোচনা হতেই পারে। সেই সুস্থতাটা যেন থাকে।

প্রশ্ন: সুদীপ্তা চক্রবর্তী এ রকমই মানসিকতার, তাই তিনি আপনার ‘অহনা’?

প্রমিতা: (একটু ভেবে) ও রকম কিছু ভাবিনি। সুদীপ্তাদির অভিনয়ের কথাটাই আগে মনে এসেছে। প্রথম থেকেই চেয়েছিলাম, ভাল অভিনেত্রীকে এই চরিত্রের জন্য নেব। তা ছাড়া, ওঁর সঙ্গে আগেও কাজ করেছি। চিত্রনাট্য পড়াতেই সুদীপ্তাদি রাজি। ছবিতে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব এবং সমাজের ভূমিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এ সবই হয়তো ওঁকে আকর্ষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে আর একজনের নাম না বললেই নয়...

প্রশ্ন: কার কথা?

প্রমিতা: অভিনেতা জয় সেনগুপ্ত। আমার ছবির নায়ক। একজন পুরুষ কী ভাবে নারীর পাশে দাঁড়ায়, জয়দা তার উদাহরণ। শুটিংয়ের আগে সব সময় হয়তো কলকাতায় আসতে পারেননি। কিন্তু সারা ক্ষণ অনলাইনে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। নিজের মতো করে পরামর্শ দিয়েছেন। নতুন ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে নিয়েছেন ওঁরা। এমনকি, যাঁরা নতুন কাজ করেছেন তাঁরাও কোমর বেঁধে শামিল হয়েছিলেন।

‘অহনা’ ছবিতে সুদীপ্তা চক্রবর্তী, জয় সেনগুপ্ত। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

প্রশ্ন: অগস্টে মুক্তি পেলেও ‘ধূমকেতু’ নিয়ে উন্মাদনা কমেনি, আপনার ছবিকে সেই উন্মাদনা ঢেকে দেবে না তো?

প্রমিতা: দেব-শুভশ্রীর বড় বাজেটের ছবির সঙ্গে ‘অহনা’র কোনও তুলনাই করা যায় না। তার উপরে ‘ফেস্টিভ্যালের ছবি’ তকমা এঁটেছে আমার ছবির গায়ে। আমি যে একা হাতে ছবি বানিয়ে মুক্তি দিতে পারছি, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট। এ ভাবেই আমি সফল। অনেক স্বাধীন পরিচালক আমায় দেখে স্বাধীন ভাবে ছবি বানানোর ইচ্ছাপ্রকাশ করছেন। এর বেশি আর কী চাই? বাকিটা ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দিয়েছি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement