অভিনয় জীবন নিয়ে অকপট চিত্রাঙ্গদা সিংহ। নিজস্ব চিত্র।
বৃষ্টিভেজা বিকেলে লালচে আগুনরঙা সিক্যুয়েলের শিফন। খোলা অবাধ্য চুল সামলাবেন, না শাড়ির আঁচল? দুইয়ের দাপটে ঈষৎ বেসামাল চিত্রাঙ্গদা সিংহ। গৌতম ঘোষের ‘পরিক্রমা’ ছবির সাংবাদিক ‘রূপা’। মাতৃত্ব, বলিউডে কুড়ি বছরের অভিনয় এবং বাংলা বিনোদন দুনিয়া— ‘আনকাট’ অভিনেত্রীর মুখোমুখি আনন্দবাজার ডট কম।
প্রশ্ন: ঘুরেফিরে আবার কলকাতা সফরে?
চিত্রাঙ্গদা: (আন্তরিক হেসে) ঠিক ঠিক! নীরজ পাণ্ডের ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’-এর পর গৌতম ঘোষের ‘পরিক্রমা’ ছবির জন্য। ঘুরেফিরে আসতে পেরে বেশ ভাল লাগছে, জানেন।
প্রশ্ন: শহরের প্রেমে পড়েছেন?
চিত্রাঙ্গদা: একদম। এখানকার মানুষ, তাঁদের আন্তরিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, হৃদয়ের উষ্ণতায় টগবগিয়ে ফুটছেন সকলে— মন ছুঁতে বাধ্য। শুটিং করতে করতে দেদার আড্ডা। আর এখানকার খাবার। লা-জবাব!
প্রশ্ন: গঙ্গার পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন কখনও? দেখেছেন নদীকে?
চিত্রাঙ্গদা: দেখেছি তো! নীরজজির সিরিজ়ের প্রচার সময় বোটে চড়ে মাঝগঙ্গা পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। ভাল লেগেছে নদীকে। তাকে ছুঁয়ে থাকা অঞ্চলগুলোও।
প্রশ্ন: নদী ভালবাসেন?
চিত্রাঙ্গদা: না ভাললাগার তো কিছু নেই! (স্মিত হেসে) ভালবাসি। আমি প্রক়ৃতিপ্রেমিক। খোলা আকাশ, নদীর পাড়, বলিউডের আরব সাগরের তীর— আমায় টানে।
প্রশ্ন: তাই আপনি গৌতম ঘোষের ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনের ছায়ায় তৈরি ছবি ‘পরিক্রমা’য়?
চিত্রাঙ্গদা: (অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে) অবশ্যই এটা একটা কারণ। কিন্তু এই একটাই কারণ নয়।
প্রশ্ন: কেন রাজি হলেন?
চিত্রাঙ্গদা: নদীর পাশাপাশি কোনও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বা উন্নয়নের স্বার্থে কিছু করতে গেলে কী ভাবে সেটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়— সেটিও বলা হয়েছে ছবিতে। আমার কাছে ছবিটি এই কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। কী জানেন তো, সব সময় বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে ছবি বানানো উচিত নয়। ছবি বাছাও উচিত নয়। কিছু ছবি এমন থাকে যা বাস্তব দেখায়। মানবিকতার কথা বলে। ‘পরিক্রমা’ তেমনই ছবি। চিত্রাঙ্গদা তাই এই ছবিতে।
‘পরিক্রমা’ ছবিতে চিত্রাঙ্গদা সিংহ, আরিয়ান বাতকুল। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: ছবিতে আপনি কোন ভূমিকায়?
চিত্রাঙ্গদা: এক সাংবাদিকের ভূমিকায়। একটা সময় আশ্রয়হীন, অনাথ শিশুদের জন্য কাজ করেছে। নাম রূপা (বলেই জোর হাসি)। শুধুই সাংবাদিকতা করি না। সাহিত্যের সঙ্গেও যুক্ত, বই লিখেছি।
প্রশ্ন: সাংবাদিকদের যা যা খারাপ দেখেছেন সব পর্দায় দেখিয়েছেন তো?
চিত্রাঙ্গদা: (হা হা হাসি) কী যে বলেন! আমি এ রকম ব্যবহার কারও থেকে পাইনি। তা ছাড়া, রূপা সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যিকও। তাই একটু অন্য রকম। আর সাংবাদিকতা সহজ কাজ নয়। পেশার খাতিরে যা যা করতে হয় সেটাই আপনারা করেন। আপনাদের প্রতি, আপনাদের কাজের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা, সম্মান আছে।
প্রশ্ন: নদী আর নারী সমার্থক। উভয়েই আশ্রয়দাত্রী। দু’জনকেই ‘মা’ সম্বোধন কর হয়। এটিও একটি দিক?
চিত্রাঙ্গদা: (একটু থমকে) এ রকম তো ভাবিনি! সত্যিই ভাবিনি। ভাবা উচিত ছিল। বড় ভাল বললেন। সত্যিই তো, নদী আর নারীকে আমরা ‘মা’ হিসাবে দেখি। উভয়েই জীবনদাত্রী। কিছু না কিছু দেয় আমাদের। হ্যাঁ, এই দিকটিও ছবিতে আছে। যাঁরা মাতৃহীন আর যাঁরা আশ্রয়হীন— দু’জনেরই প্রায় এক অবস্থা।
প্রশ্ন: পর্দার মতো চিত্রাঙ্গদাও বাস্তবে মা... অভিনয়ে ছায়া ফেলেছে?
চিত্রাঙ্গদা: ছবিতে সরাসরি সে ভাবে মাতৃত্ব দেখানো হয়নি। ‘লালা’ নামের ভিটেমাটি হারানো কিশোরকে দেখলে সকলেরই মায়া হবে। যে কোনও নারী তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িতে দেবে। ছবিতে সাংবাদিক-সাহিত্যিক রূপাও সেটাই করেছে।
প্রশ্ন: প্রথম বাঙালি পরিচালকের সঙ্গে কাজ। গৌতম ঘোষ কেমন?
চিত্রাঙ্গদা: খুব ভাল। খুবই ভাল। আগে আলাপ ছিল না আমাদের। আমার চেনা পরিচালকদের থেকে একদম ভিন্ন, অন্য ঘরানার। ভীষণ আলাদা রকম ভাবে ছবিতে গল্প বলেন। ছবি তৈরি করেন। প্রত্যেকটি দৃশ্যে অনুভূতি ছড়িয়ে দেন। কোনও চালাকি নেই ওঁর কাজে। অনেক বছর আগে গৌতমদার একটাই ছবি দেখেছি, ‘পার’। আমি তাতেই মুগ্ধ।
প্রশ্ন: মনে রাখার মতো কিছু ঘটল?
চিত্রাঙ্গদা: আমরা অমরকণ্টকে শুটিং করতে গিয়েছিলাম। আমি খুব ধার্মিক নই, আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ওখানে পুজো দিতে গিয়ে বা শুটিং করতে ঐশ্বরিক শক্তির অনুভূতি হয়েছিল। তা ছাড়া, ‘লালা’ চরিত্রাভিনেতা আরিয়ান বাদকুলের সঙ্গে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমরা এক সঙ্গে অনেক দৃশ্য করেছি। ছোট হলে কী হবে, খুব বুদ্ধিমান ছেলে।
প্রশ্ন: ২০০৫-এ সুধীর মিশ্রের ‘হাজার খোয়াইশে অ্যায়সি’ দিয়ে শুরু। ২০ বছর পরের বলিউড কেমন?
চিত্রাঙ্গদা: অনেক বদল ঘটেছে। সবচেয়ে বড় বদল, এখন সব কিছুই ভীষণ ‘কর্পোরেট’। দ্বিতীয় বদল, করোনা-পরবর্তী কালে ওটিটির রমরমা। তৃতীয় বদল, সমাজমাধ্যম। যা বিনোদন দুনিয়ার সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে। এখন অনেক কিছু নির্ধারিত হয় সমাজমাধ্যম দেখে।
প্রশ্ন: সমাজমাধ্যমে প্রচুর অনুসরণকারী মানেই তিনি অভিনয় পারেন?
চিত্রাঙ্গদা: (একটু ভেবে) না, নেটপ্রভাবী মাত্রেই তিনি অভিনেতা বা ভাল অভিনয় পারবেন— হয় না। আমি কাউকে ছোট করছি না। হতেই পারে নেটপ্রভাবী সুযোগ পেলে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন। কিন্তু লক্ষ অনুসরণকারী মানেই তিনি অভিনেতা— এটা নয়। যেমন, টম ক্রুজ়ের অনুসরণকারীর সংখ্যা ৩০ মিলিয়ন। আমাদের দেশে চার-পাঁচ জন এমন আছেন যাঁদের ৭০ মিলিয়ন অনুসরণকারী! তাঁরা কি তা হলে টম ক্রুজ় হয়ে গেলেন? নাকি তাঁকে ছাপিয়ে গেলেন? অভিনেতাদের সারাক্ষণ সমাজমাধ্যমে ব্যস্ত থাকা, স্টোরি পোস্ট করা, অনুসরণকারী বাড়ানো কাজ নয়। তাঁদের কাজ ভাল অভিনয়। পরিচালকদেরও বুঝতে হবে, অভিনয় আর সমাজমাধ্যমে প্রভাব বিস্তার এক নয়।
প্রশ্ন: করোনার পরে সব কিছু ওটিটি-নির্ভর। দর্শক প্রেক্ষাগৃহে কম যান। এটা কেমন লাগে?
চিত্রাঙ্গদা: কখনও কখনও খারাপ লাগে। আবার এটাও বুঝতে হবে, ওটিটি আছে বলেই নানা ধরনের সিরিজ় তৈরি হচ্ছে। এটাও একটি মাধ্যম।
প্রশ্ন: আপনার ঝুলিতেও নানা ধরনের কাজ। কোন ধারার কাজ আপনার প্রিয়?
চিত্রাঙ্গদা: যত রকমের ঘরানার ছবি হয়, সব রকমের কাজ করতে পছন্দ করি। আমি থ্রিলার ভালবাসি। ড্রামা ভালবাসি। রোমান্টিক ছবি তো খুবই ভালবাসি। আবার ‘মান্ডি’র মতো সিরিয়াস ছবিতেও আপত্তি নেই। যত নানা স্বাদের চরিত্র তত কাজ করে মজা।
গৌতম ঘোষের ‘পরিক্রমা’ ছবির বিশেষ প্রদর্শনে চিত্রাঙ্গদা সিংহ। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: রোমান্টিক ছবি পছন্দ, আপনার জীবনে প্রেম আছে?
চিত্রাঙ্গদা: (হেসে ফেলে) আমার কাছে এর কোনও উত্তর নেই।
প্রশ্ন: বাকি বাঙালি পরিচালকদের সঙ্গে কাজ বাকি রইল...
চিত্রাঙ্গদা: অবশ্যই। যিনিই ভাল চরিত্রের জন্য ডাকবেন আমি তাঁর সঙ্গেই কাজ করব।
প্রশ্ন: একুশ শতকের ‘মা’ কেমন হবেন?
চিত্রাঙ্গদা: মা, মা-ই। মায়ের সংজ্ঞা কখনও বদলায় না। আমার মা আমার সঙ্গে যেমন যে ভাবে ছিলেন, আমিও আমার ছেলের সঙ্গে সে ভাবেই থাকার চেষ্টা করি। বলতে পারেন, এখন সন্তান আর মায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশি। অনেক খোলামেলা কথা হয় দু’জনের মধ্যে। পাশাপাশি, সন্তানের কথা শুনতেও হবে। ওদের মতামত দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই না সন্তান ঠিকমতো বে়ড়ে উঠবে।
প্রশ্ন: ‘খাকি ২’-এর ‘নিবেদিতা বসাক’ বাস্তবে রাজনীতি করবেন?
চিত্রাঙ্গদা: একদম না। আমি রাজনীতি পারিই না। পছন্দও করি না। বরং গেলে দু’দিনে ওখান থেকে আমায় সরিয়ে দেওয়া হবে (ফের জোরে হাসি)।