বাবা বাঙালি। মা পোলিশ। জন্ম কানাডার টরন্টোয়। শৈশবের কিছু দিন কেটেছিল হুগলির শ্রীরামপুর এবং তারপর কলকাতায়, তাঁর বাবার ছেড়ে যাওয়া দুই শহরে। বলিউড ও হলিউডের অভিনেত্রী হওয়ার পরেও লিসা রানি রে ভুলতে পারেন না নিজের বাঙলার মাটিতে থেকে যাওয়া নিজের পুরনো শিকড়।
আজন্ম বড় হওয়া মিশ্র সংস্কৃতিতে। একদিকে যেমন ঝরঝরে পোলিশ বলতে পারেন, আবার অন্যদিকে লিসা ভক্ত সত্যজিৎ রায়ের ছবির। লিসার বাবা কর্মসূত্রে কানাডায় গিয়েছিলেন। পরে সেখানেই থিতু হন। বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝেই ভারতে আসতেন লিসা। পরিজনদের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হতে দেননি তাঁরা।
প্রথম মডেলিংয়ের সুযোগও এসেছিল ভারতে ছুটি কাটাতে এসেই। কিশোরী লিসা সে বার বম্বে ডাইং-এর হয়ে মডেলিং করেন। কালো সাঁতার-পোশাকে নজর কেড়ে নেন করণ কপূরের বিপরীতে।
এরপর বিখ্যাত ফ্য়াশন পত্রিকার প্রচ্ছদেও দেখা যায় তাঁকে। তবে সে সময় বিনোদন দুনিয়ায় থাকার ইচ্ছে ছিল না লিসার। তিনি কানাডায় ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া জীবনে মন দেন। কিন্তু সব পরিকল্পনা চুরমার করে দেয় একটি গাড়ি দুর্ঘটনা।
সেই দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন তাঁর মা। চলার শক্তি হারিয়ে তিনি বাকি জীবনের জন্য হুইলচেয়ারবন্দি হয়ে পড়েন। এরপর লিসা আবার ভারতে ফিরে এসে মডেলিংয়ের কেরিয়ার শুরু করেন।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সুপারমডেলের তকমা পান লিসা। বিজ্ঞাপনের মডেলের পাশাপাশি তিনি জনপ্রিয় হন বিভিন্ন টিভি শো-এর সঞ্চালিকা হিসেবেও। বেশ কিছু ছবির অফার ফিরিয়ে তিনি প্রথম বার হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন, ২০০১ সালে। আফতাব শিবদাসানির বিপরীতে ‘কসুর’ ছবিতে।
সে সময় হিন্দি বলতে পারতেন না লিসা। তাঁর কণ্ঠ ডাব করেছিলেন আর এক অভিনেত্রী দিব্যা দত্ত। এরপর দীপা মেহতার পরিচালনায় অভিনয় করেন ইন্দো-কানাডিয়ান ছবি ‘বলিউড হলিউড’-এ।
এরপর লিসা অভিনয় ছেড়ে পারফর্মিং আর্টস নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন পাড়ি দেন। সে সময় দীপ মেহতার ছবি ‘ওয়াটার’-এ অভিনয় করেন তিনি। এই ছবিতেও শেষ অবধি তাঁর কণ্ঠ ডাবিং করানো হয়।
লিসার কাজের পরিধি ক্রমশ বড় হতে থাকে। তিনি অভিনয় করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের প্রোডাকশনের ছবিতে। কাজের সূত্রে তিনি বেশিরভাগ সময় থাকতেন প্যারিস ও নিউ ইয়র্কে।
২০০৮ সালে আবার তাঁর জীবনের ছন্দ কেটে গেল। প্রয়াত হন তাঁর মা। পরের বছর জানা যায়, লিসা নিজে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। কিন্তু লড়াকু লিসা হার মানেননি। এক বছর ধরে চিকিৎসা এবং তার পরে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পরে লিসা ‘ক্যানসারমুক্ত’ হন ২০১০ সালে।
চিকিৎসাপর্ব চলার সময় লিসা লেখালেখি শুরু করেন। ভারতীয় ও বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও তিনি যুক্ত বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রকল্পের সঙ্গে। তাঁর কাজের মধ্য়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রসার।
২০১২ সালে ক্য়ালিফোর্নিয়ায় লিসা বিয়ে করেন ম্যানেজেন্ট কনসালট্যান্ট জ্যাসন ডেহনি-কে। সাত বছর পরে, ২০১৯ সালে সারোগেসির মাধ্যমে দুই সন্তানের মা হন লিসা। বাচ্চাদের নাম রেখেছেন ‘সুফি’ এবং ‘সোলেইল’।
দীর্ঘ বিরতির পরে লিসা ফিরে এসেছেন বলিউডেও। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত ‘ইশক ফরএভার’ ছবিটি। এরপর গত কয়েক বছরে কাজ করেছেন ‘বীরাপ্পন’, ‘দোবারা’ এবং ‘৯৯ সংগস’ ছবিতেও।
নিজের কাজ, সংসার এবং মাতৃত্বকে উপভোগ করছেন লিসা। তার মাঝেও ভোলেন না বাঙালির শিকড়ের টান। মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন নিজের ফেলে আসা শৈশবের ছবি।