শুটিংয়ে পরিচালকের সঙ্গে মমতা-অঞ্জন
প্রথমেই আমার নায়ক হওয়ার সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে দিলেন মৃণাল সেন। লম্বা চুল কেটে দিলেন। তার পর তেল মাখিয়ে, রোগা চেহারায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে দৌড় করালেন। দৌড়তে দৌড়তে মাঝে মাঝে পরিচালকের কথা শুনতে পারছি না। সে কথা বলতেই উনি রেগে বলে উঠলেন, ‘যা মনে হয়, সে রকম করো। ন্যাচারাল রিঅ্যাকশন।’
ছবির নাম ‘চালচিত্র’। একুশ বছরের উঠতি, উচ্ছৃঙ্খল, পুরোদস্তুর অরাজনৈতিক, তার্কিক, ডেঁপো এক ছেলের সঙ্গে পঞ্চান্ন বছর বয়সি পৃথিবীখ্যাত পরিচালকের বন্ধুত্বের শুরু। বন্ধু কথাটা ভুল নয়। অজস্র তর্ক, ভালবাসায় কেটেছে সেই সব দিন। ওঁর ছেলে কুনালও ওঁকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকত। মৃণাল সেন আমার বন্ধু, শিক্ষক, পরিচালক, সহকর্মী, বাবার মতো অনেক কিছুই। এমনকি, বাবা যে স্বাধীনতা আমাকে দেননি, উনি সেটাও দিয়েছিলেন। ‘খারিজ’-এর পর ওঁকে ডেঁপোমি মেরে সার্ত্র, অস্তিত্ববাদ উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছিলাম, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যই সব। সামাজিক সমষ্টি নয়। উনি বলতেই পারতেন, এর পর রোল দেব না। উল্টে আমাকে হাতচিঠি পাঠালেন, ‘না, সমষ্টিই সব।’
মৃণাল সেন কোনও কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন না। কিন্তু মানুষের ভিড় ও মিছিল ওঁকে উদ্দীপ্ত করে এসেছে। মৃণালদাকে দেখেছি, তর্ককে প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু স্তাবকতাকে নয়। নন্দীগ্রাম নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলের সময়ে উনি বললেন, ‘আমিও যাব।’ এসপ্ল্যানেড থেকে একটু নিয়ে যাওয়া হল। পরদিন ওঁকে ক্ষমতাসীন নেতাদের ফোন। সেই মিছিলেও গেলেন। লোকে বলতে শুরু করল, উনি বৃদ্ধ হয়েছেন। আমি নীরব ছিলাম। কারণ ‘মানুষের সঙ্গে আছি, সেটাই আমার জায়গা’ এই বার্তাই উনি বারংবার দিতে চেয়েছেন।
আরও পড়ুন: ‘উনি আমার নাম বদলে রেখেছিলেন মাধবী’, স্মৃতিচারণে মাধবী
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক দিন হঠাৎ আমার ‘বং কানেকশন’ ছবি দেখতে হাজির। ওঁকে নেমন্তন্নও করিনি। কিন্তু উনি এসে জানালেন, ‘মৃণালদা বললেন, ভাল ছবি।’
আরও পড়ুন: প্রথম আয় মৃণালদার জন্যই, স্মৃতিসুধা ভাগ করে নিলেন মমতা শঙ্কর
মৃণালদা এই রকমই। এক দিকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা বাঙালিয়ানা, অন্য দিকে অকুণ্ঠ আন্তর্জাতিকতাবোধ। সংসারের ধরাবাঁধা নিয়ম না মেনে সকলের বন্ধু হয়ে ওঠেন। কখনও আমাদের প্রেম নিয়ে শুনতে চান, দুর্দশা টের পেলে কিছু জানতে না দিয়ে পকেটে সিগারেট, টাকা গুঁজে দেন। ‘টাকা কেন, মৃণালদা?’ উত্তর, ‘তুই পেতিস। ভুলে গিয়েছিস।’ ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবে গেল ‘চালচিত্র’। দেখি, ব্রায়ান ডি পালমা, রবার্ট ডি নিরো থেকে সিডনি লুমেট সবাই ওঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। তার আগে আমাকে পইপই করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ওখানে আমাকে মৃণাল বলবি। মৃণালদা একদম নয়!’
অনুলিখন: গৌতম চক্রবর্তী