তমলুক থেকে নিউ ইয়র্ক

তবুও ছোটবেলার গ্রামের কাদা-জলের রং আজও তাঁর ক্যানভাসে। পরেশ মাইতি-র কথা শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়পরেশ মাইতি। তাঁর ৭৪তম একক চিত্র প্রদর্শনীর জন্য ডিসেম্বরের কলকাতায়। লাল পাঞ্জাবি, কালো জ্যাকেট আর রুপোর বাহারি লকেটের জৌলুসে তাঁর ক্যানভাসের মতোই তিনি বর্ণময়। বললেন, ‘‘কথা নয়, আগে ছবি দেখুন। আমার ছোটবেলার সেই গ্রাম। সাদা জলের মাঝে নৌকো ভেসে যাচ্ছে। তীরে তখন রাত কালো।’’

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০০
Share:

পরেশ মাইতি: রিফ্লেকশন অব প্যাশন। নিজের ছবির সামনে। সিমা আর্ট গ্যালারিতে। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

পরেশ মাইতি। তাঁর ৭৪তম একক চিত্র প্রদর্শনীর জন্য ডিসেম্বরের কলকাতায়। লাল পাঞ্জাবি, কালো জ্যাকেট আর রুপোর বাহারি লকেটের জৌলুসে তাঁর ক্যানভাসের মতোই তিনি বর্ণময়। বললেন, ‘‘কথা নয়, আগে ছবি দেখুন। আমার ছোটবেলার সেই গ্রাম। সাদা জলের মাঝে নৌকো ভেসে যাচ্ছে। তীরে তখন রাত কালো।’’

Advertisement

৭৪-তম এক্সিবিশনটা তো দেখতেই পাচ্ছি। পঁচাত্তরে কী?

Advertisement

সিনেমা করার ইচ্ছে আছে। মিডিয়ামটা বদলাবে। কিন্তু বিষয়টা ছবি আঁকা নিয়েই হবে। হয়তো আমার ছেলেবেলার কথা থাকবে। আমি খুব পুরনো দিনের লোক। তমলুকের মাটির বাড়ি, আলোহীন দাওয়া, সবুজ ঘাস, কাদা জলের মেঠো নদী আমায় তৈরি করেছে। ওখান থেকেই প্রকৃতিকে এঁকেছি। আপন মনেই তো মাটি দিয়ে মূর্তি গড়তাম তখন— দুর্গা, কালী, এই সব। প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, মুম্বই যেখানেই যাই না কেন, সেই কাদা-জলের গন্ধ ভুলি না।

সিমা আর্ট গ্যালারির ‘সাউন্ডস অব সায়লেন্স’— এই প্রর্দশনীতেও দেখছি ক্যানভাসে তুলির টানে নানা রকম নৌকা। এখানেও কি সেই ছেলেবেলার স্মৃতি?

তমলুকের নদীনালায় নৌকা বাঁধা থাকত। নৌকা তো প্রকৃতির মধ্যে মানুষের হাতেই চলে। নৌকার প্রাণ আছে, জানেন! নদীতে বাঁধা থাকলেও জলের ছোঁয়ায় থেকে থেকেই কেঁপে ওঠে! এটা মুগ্ধ করে আমায়।

শোনা যায়, অমিতাভ বচ্চন থেকে শাহরুখ খান... এই রকম ক্লায়েন্টেল আপনার...

রানি মুখোপাধ্যায়ও আমার ছবি কিনেছেন। আসলে আমি আর আমার স্ত্রী জয়শ্রী (বর্মন) সুযোগ পেলেই একসঙ্গে সিনেমা দেখি। আমরা অমিতজির যেমন ভক্ত, তেমন শাহরুখেরও ভক্ত।

সবটাই তো শিল্পের জন্য। দু’তরফের কাজেই একটা ভাললাগা তৈরি হয়েছে। আর সেই ভাললাগা থেকেই তো সম্পর্ক।

‘দিলওয়ালে’ দেখতে যাবেন?

(একটু হেসে) সময় পেলে নিশ্চয়ই যাব। তবে অবশ্যই জয়শ্রীর সঙ্গে।

পরেশ মাইতি জলরঙে আঁকতেন নিসর্গ। সেখানে হঠাৎই সম্পর্ক, নারী-পুরুষের মুখ চলে এলো...

১৯৯০ পর্যন্ত বাংলায় ছিলাম। তখন আকাশ, নদী, গ্রামের গল্প আসত আমার ছবিতে।

আপনি ব্রিটিশ ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট টার্নারের খুব ভক্ত ছিলেন, না?

শুধু টার্নার নয়, কনস্টেবলের রোম্যান্টিসিজম আমায় খুব টানত। ডেস্টিনি যখন আমায় দিল্লি নিয়ে গেল তখন সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ দেখার আশায় রাজস্থানে গেলাম। ভাবুন তো, রাজস্থানের প্রকৃতিতে কোনও রং নেই। কিন্তু মানুষগুলো তাঁদের আবেগ দিয়ে ওই রুক্ষতায় কত যে রং ঢেলেছে, তা বিস্ময়কর। এক দিকে রাজস্থানী মেয়েরা, অন্য দিকে স্টিভ ম্যাকারির সেই আফগান গার্ল— এদের দেখেই আমি ফুটিয়ে তুলেছি নানা মুখের মেয়েদের অবয়ব। মরুভূমির যে কত রূপ! ওগুলোই আমার সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল। তখন থেকেই ইমেজ তৈরি হল আমার রঙে। পুরুষ- মহিলা মুখের নানা ধাঁচ আমার ছবিতে বাস করতে আরম্ভ করল। একে একে চলে এল লাভ, ফ্যান্টাসি, ইমোশন। সোলো এক্সিবিশন হল দিল্লিতে। ছবিও কিনল লোকে।

ল্যান্ডস্কেপ থেকে সম্পর্কের ছবি। এ বার নতুন কী ভেবেছেন?

ছোটবেলার ওই মূর্তি গড়া এ বারের সিমা আর্ট গ্যালারির এক্সিবিশনে নতুন করে ফিরে এল। ফিরে এল বিরাট বড় বড় ব্রোঞ্জের স্কাল্পচার। ইনস্টলেশনই এ বার নতুন কাজ আমার। ছোটবেলায় গ্রামে থাকতাম, চারিদিকে পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াত, কী ডিসিপ্লিন, কী প্যাশন ওদের! সেই স্মৃতি থেকে ৫০টা পিঁপড়ে বানিয়েছি ১৫০টা মোটরবাইককে ভেঙে। ওটা বিড়লা অ্যাকাডেমিতে থাকছে। সিঙ্গাপুরে, সুইজারল্যান্ডে, অস্ট্রেলিয়ায় খুব প্রশংসিত হয়েছে এই ইনস্টলেশন। মোটরসাইকেলের যে যে অংশ দিয়ে পিঁপড়ের মাথা বানিয়েছি সেগুলোও জ্বলবে। একেকটা জায়েন্ট অ্যান্টের মতো লাগবে। কলকাতায় এই কাজ প্রথম।

মোটরসাইকেল কেন?

আমার জীবনের জার্নিটাই একটা আর্ট। মোটরসাইকেলের যে দুর্দান্ত গতি সেটা কোথাও যেন আমার জীবনের গতির সঙ্গে মিলে যায়।

শুনেছি তমলুক থেকে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে আসতে অনেকটা জার্নি করতে হত আপনাকে? অন্যান্য ছাত্ররা যে ফিল্ড ওয়ার্ক করার, ওয়ার্কশপ করার সময় পেতেন আপনি সেটা পেতেন না।

আমার তখন পয়সা ছিল না যে কলকাতায় বাড়িভাড়া করে থাকব। কলেজ থেকে বাড়ি যাতায়াতেই আট ঘণ্টা লেগে যেত। আমি ট্রেনে যেতে যেতেই স্কেচ করতাম, থিয়োরি পড়তাম। হাওড়া স্টেশনে বসে আছি, হয়তো ট্রেন লেট, ওখানে বসেই ছবি আঁকতাম। কী করব! রাত বারোটা বেজে যেত বাড়ি ফিরতে। বর্ষা বা বসন্ত, সাপ, কাদা, জল পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছই, তো আবার ভোরে বেরোনোর তোড়জোড়। কিন্তু জীবনে ক্লাসে লেট হইনি, বা কোনও দিন কামাই করিনি। এই স্ট্রাগলটাই আমায় হয়তো কাজের প্রতি আরও বিশ্বস্ত করেছে। জার্নিটাই আমার জীবন। আর জীবনটা আমার আর্ট।

এই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজেই কি লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় আপনার ছবির সোলো এক্সিবিশন করার প্রস্তাব দেন?

ওটাই আমার প্রথম সোলো এক্সিবিশন। যখন কলেজে পড়তাম তখন থেকেই বড় বড় ক্যানভাসে ওয়াটার কালার আঁকতাম। আমি তখন থার্ড ইয়ারের ছাত্র। রাণুদি আমার ছবি দেখে বললেন, ‘রথীন (মৈত্র), তুমি পরেশের সোলো এক্সিবিশন করো।’

গণেশ হালুইকে একবার বলতে শোনা গিয়েছিল ‘ওয়ার্কশপের সময় অন্যান্য আর্টিস্টরা যখন কাজ ভুলে আড্ডা মারে, মজা করে পরেশ কিন্তু তখনও একটানা কাজ করে যায়।’ আর্টিস্টরাও কি অরগ্যানাইজড হয়?

দেখুন, আমার মধ্যে কাজ ঘিরে সারাক্ষণই একটা ছটফটানি চলে। আমি ছবি ছাড়া কিছু বুঝি না। এই যে এখন সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, তার মাঝেও রং-ছবি নিয়ে ভেবে যাচ্ছি। এটাই আমি।

ভাগ্যিস আপনার স্ত্রীও একজন শিল্পী। নয়তো দাম্পত্য কলহ লেগে যেত তো?

জয়শ্রী (বর্মন) আর আমি দু’জনেই দু’জনকে যথেষ্ট স্পেস দিই। আমরা দু’জনে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার আর্টিস্ট। কারও কাজের সঙ্গে কারও কাজের কোনও মিল নেই।

একই পেশা যেহেতু তাই জিজ্ঞেস করছি ‘অভিমান’য়ের মতো কখনও কোনও ঘটনা...

না না, ও সব ভাবার মতো সময় আমাদের কারও নেই। এমনও হয়েছে আমরা এক স্টুডিয়োয় বসে একই বিষয়ে কাজ করেছি। ধরুন দু’জনেই গাছ আঁকছি। কিন্তু দু’জনের মন থেকে বেরিয়ে আসবে সম্পূর্ণ দুটো আলাদা গাছ। আমরা একসঙ্গে প্রচুর বেড়াতে যাই। কিন্তু বেড়াতে গিয়ে একই মানুষকে অন্য ভাবে আঁকি।

আজকের দিনে পরেশ মাইতি ছাড়া জলরঙের এত বড় ক্যানভাসের শিল্পী আর কেউ নেই...

আসলে জলরঙের মাধ্যমটা এত শক্ত যে তা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এই মিডিয়ামটার মধ্যে অদ্ভুত একটা চ্যালেঞ্জ আছে, একটানে এঁকে যেতে হবে। ভাল হলে পাশ, খারাপ হলে ফেল।

এ দেশের শিল্পীদের মধ্যে কারা আপনাকে ইন্সপায়ার করেছেন?

নন্দলাল বসু, বিকাশ ভট্টাচার্য—কার কার নাম বলব? ‘মিনিমাম ওয়ার্ক, ম্যাক্সিমাম এক্সপ্রেশন’—এঁদের এই মানসিকতার ছবি দেখতে দেখতেই তো বড় হয়েছি। আমার মনে আছে ভেনিস থেকে ফিরে মকবুল ফিদা হুসেনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল আমার। দেশে ফিরে শুনি উনি আর নেই। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

এ দেশে কিন্তু এখন আর এক্সপ্রেশানিস্ট মুভমেন্ট নেই। আপনি কী মনে করেন?

আর্টকেও সময়ের সঙ্গে বদলাতে হবে। এখন ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক মুভমেন্টের চল। প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে আর্ট নিয়ে। চোখের জানলাটা খোলা রাখা চাই। তবে ছবি আঁকতে আঁকতেও অনেক অতৃপ্তি জন্মায়। মন খারাপ হয়।
অতৃপ্তি থেকেই নতুন ছবির জন্ম হয়। আমি আমৃত্যু শিশুর মতো ছবি এঁকে যেতে চাই।

সিমা আর্ট গ্যালারির ‘সাউন্ডস অব সায়লেন্স’এর এই প্রদর্শনীতে আর কী কী থাকছে?

এ বারে আমার করা চারটে শর্টফিল্ম দেখানো হবে। এগুলো কলকাতায় আগে দেখানো হয়নি। কলকাতার মতো প্রাণবন্ত শহর পৃথিবীতে কমই আছে। এই যে সবাই বলছে না শীত পড়ছে না-পড়ছে না, আমি নর্থ ইন্ডিয়া থেকে কলকাতার জন্য শীত নিয়ে এসেছি। সারপ্রাইজও আছে একটা।

কী সারপ্রাইজ?

আমার পছন্দের কিছু ছবি এ বার প্রদর্শনীতে রাখছি যা আগে কখনও রাখিনি। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে আর সিমা আর্ট গ্যালারিতে একই সঙ্গে এই প্রদর্শনী ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত চলবে।

কলকাতায় এলে কী খেতে ইচ্ছে করে?

আরে কলকাতার চার্মই আলাদা। বিরিয়ানি আর শিঙাড়া কলকাতার মতো এত ভাল কোত্থাও আর পাওয়া যায় না। কলকাতায় এলে ওগুলো খাবই।

ছবি ছাড়া পরেশ মাইতির অন্য কোনও নেশা আছে কি?

আমি ছবির ক্রীতদাস। প্রতি মুহূর্তেই জীবনটাকে ছবিতে কনভার্ট করে চলেছি। তবে আমার রোজের রুটিনে যোগা আর বিকেলের হাঁটা মাস্ট।

যে শিল্পী ইনস্টলেশনের মতো আধুনিক বিষয় নিয়ে এমন বিস্ময়কর কাজ করছেন তার হোয়াটসঅ্যাপ তো দূরস্থান, ইমেল পর্যন্ত নেই। আজকের দিনে এও কি সম্ভব?

খুব সম্ভব। আমার এসব কিছু নেই। এত যে একক প্রদর্শনী হয়েছে আমার সেগুলো সবই গ্যালারি থেকে করা হয়েছে। আমি একা কোনও দিন কোনও প্রদর্শনী করিনি। আমার যোগাযোগ সব গ্যালারি থেকেই।
তবে ছবি আঁকাই শুধু নয়। ছবি তোলাও আমার শখ। আজও ফিল্মে ছবি তুলি। সাদাকালো ছবির ফ্রেম আমাকে পাগল করে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন