Kaushiki Chakraborty's Birthday

কন্যার যে আদর, খুব ভাল করে সেটা করা হয়নি কোনও দিন! কৌশিকীর জন্মদিনে অকপট অজয় চক্রবর্তী

গোয়ালঘর থেকে কৌশিকী যে টাইম্‌স স্ক্যোয়ারে পৌঁছোতে পেরেছে, তার সবটাই আপনাদের আশীর্বাদ। ওর জন্য প্রার্থনা করবেন।

Advertisement

অজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:০৭
Share:

অজয় চক্রবর্তীর কলমে কৌশিকী চক্রবর্তী। ছবি: ফেসবুক।

আনন্দবাজার ডট কম-এর তরফ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে, শিল্পী কৌশিকী নন, কন্যা কৌশিকীকে তুলে ধরতে হবে। তা হলে শুরু করি?

Advertisement

বাংলা তারিখ অনুযায়ী, কৌশিকীর জন্মদিন আর ওর মায়ের জন্মদিন একদিনে, ৭ কার্তিক। ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী, কৌশিকী জন্মেছে ২৪ অক্টোবর। কিন্তু, আমরা ৭ কার্তিক, অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর মেয়ের জন্মদিন পালন করি।

জন্ম থেকেই ওর খেলনা হল গান। সঙ্গীত ওর বন্ধু। শুধু গান নিয়েই থাকতে ভালবাসত। আর যখনই গানের বিষয়, তখনই আমার ‘অভিভাবকত্ব’ বড় হয়ে উঠত। কন্যার যে আদর পাওয়া উচিত, তা খুব ভাল করে করা হয়নি কখনও। খুব কম করেছি। আর একটি ব্যাপার, ওর যখন জন্ম, তখন থেকেই আমার প্রচণ্ড ঘোরাঘুরি। এর ফলে খুব ছোট থেকেই দেশের তাবড় শিল্পীদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ। বিলায়েৎ খাঁ থেকে শুরু করে রবিশঙ্কর, আল্লারাখা খাঁ সাহেব থেকে জাকির হোসেন, শিবকুমার শর্মা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া— এঁদের সাহচর্যে বড় হয়েছে কৌশিকী। ফলে, ওর শিক্ষা, সহবত, আচার-আচরণে এঁদের প্রভাব বেশি।

Advertisement

আর একটি গুণের কথা বলতেই হবে, কৌশিকী বরাবর খুব বাধ্য মেয়ে। কোনও শর্ত ছাড়াই কথা শুনত। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই প্রজন্মের মধ্যে যার বড় বেশি অভাব। পছন্দের মধ্যে, হাতভর্তি কাচের চুড়ি পরতে বড্ড ভালবাসে আমার মেয়ে। ছোটবেলায় গানের পাশাপাশি ছবি আঁকায় ঝোঁক ছিল। মনোযোগ দিলে ওই বিষয়েও হয়তো প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। কিন্তু গানের কারণে, ওই দিকটি গুরুত্ব পায়নি।

কৌশিকীর বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। ওই বয়সে গুরুজির কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গীতশিক্ষার জন্য। তার আগে ও বেড়ে উঠেছে আমার মা-বাবার কাছে! কারণ, আমার মা-বাবা ওকে ওর মা-বাবার কাছে থাকতে অনুমতি দিতেন না। বাবার কেন জানি না মনে হয়েছিল, আমার কাছে থাকলে কৌশিকী মানুষ হবে না। আমিও মা-বাবার বাধ্য সন্তান। ফলে, আমি বা আমার স্ত্রী কোনও দিন জোরাজুরি করিনি যে, কৌশিকী আমাদের কাছে থাকবে।

এ বার মেয়ের পড়াশোনার গল্প বলি। ছয় বছর বয়সে কৌশিকীকে প্রথম স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছি। কারণ, আমিও ছয় বছর বয়সে প্রথম স্কুলে গিয়েছি। পাঠভবনে নিয়ে যেতেই প্রধানশিক্ষিকা অবাক। আমার প্রশ্ন করলেন, “আপনি জানেন না, এখন তিন বছর বয়সে বাচ্চারা স্কুলে ভর্তি হয়?” স্বীকার করলাম, জানি না। পাঠভবন পত্রপাঠ আমাদের বিদায় জানাল। এক বর্ষার দিনে, হাঁটুজলে স্কুলের ফর্মের জন্য লাইনে দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়েছি। দু’ঘণ্টা পরে জানতে পারলাম, ছ’বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয় না!

বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বললাম, আমার মেয়ে অশিক্ষিত থাক। ও গান করবে। স্কুলে না পড়াশোনা করলেও আমার কিছু এসে যায় না। এ রকম অবস্থায় সত্যজিৎ রায়, যাঁকে আমি মানিকমামা ডাকতাম, তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। নিয়মিত বাড়ির সকলের খোঁজখবর নিতেন। তিনি সবটা শুনে খুব অবাক। তার পর জোরে হেসে উঠলেন। ভারী গলায় বললেন, “ও তোমায় চিন্তা করতে হবে না। আমি দেখে নেব।”

পরে জানলাম, পাঠভবনের প্রধানশিক্ষিকা সত্যজিৎ রায়ের বোন। তিনি বোনকে ফোন করে দিলেন। তার দিন পনেরো পরে পাঠভবনে, প্রথম শ্রেণিতেই ভর্তি হল কৌশিকী।

কিন্তু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রেণিতে একাধিক বিষয়ে ফেল! অঙ্কে চার, অন্য আর একটি বিষয়ে পাঁচ, কোনওটায় দশ— এ রকম সব নম্বর। এ দিকে, যখনই ফেল করত তখনই স্কুল থেকে বলা হত, এ বার ফল ভাল করেনি। কিন্তু পরে ভাল করবে। ওকে পরের শ্রেণিতে তুলে দেওয়া হচ্ছে! নবম শ্রেণি পর্যন্ত এ ভাবে ওঠার পর আমি কৌশিকীকে ডেকে জানতে চেয়েছিলাম, ও আর পড়বে না স্কুল ছেড়ে দিয়ে গানবাজনা নিয়ে থাকবে? কৌশিকী কথা দিল, মন দিয়ে পড়ে ভাল ফল করবে। মাধ্যমিকে ওই মেয়েই তিনটি লেটার নিয়ে পাশ করল! আর পিছনে ফিরে তাকায়নি তার পর। স্নাতক, স্নাতকোত্তর— ওর কলেজে সবেতেই কৌশিকী সেরা।

আজীবনের বাধ্য মেয়ে একবার শুধু অবাধ্য হয়েছে। নিজের পছন্দের পাত্র নির্বাচনের সময়। পার্থসারথি দেশিকান আর কৌশিকী পাশাপাশি বসে গান শিখত আমার কাছে। ফলে, ছোটবেলার বন্ধুত্ব ভালবাসায় পরিণত হয়েছিল। জামাই ভাল ছেলে জেনেও আমরা শুরুতে বাধা দিয়েছিলাম। বিস্তর মান-অভিমান জন্ম নিয়েছিল। সে সব কাটিয়ে ও এখন আমাদের ‘ঘরের ছেলে’।

জন্মদিনের কয়েক দিন আগে টাইম স্ক্যোয়ারে বিশাল ছবি আমার মেয়ের। গোয়ালঘর থেকে আমরা যে টাইম স্ক্যোয়ার পর্যন্ত পৌঁছোতে পারব, ভাবতেই পারিনি। আশীর্বাদ করুন, ও যেন আরও এগিয়ে যেতে পারে। কৌশিকীর জীবনে সকলের আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা খুব দরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement