রাহুল দেব বর্মনকে নিয়ে বললেন শান্তনু মৈত্র। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
প্রায় ২০ বছর হয়ে গিয়েছে, প্রতি মাসে দু’তিন বার গুলজ়ার সাহেবের বাড়ি যাই। এমন কোনও দিন আসেনি যে দিন রাহুল দেববর্মণকে নিয়ে উনি কথা বলেননি! এর থেকেই বোঝা যায়, আর ডি বর্মনের কী প্রচণ্ড প্রভাব ওঁর উপরে! এখনও। ওঁর কথা শুনলে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি আর ডি বর্মণকে ভুলতে পারেননি। এমন করে বন্ধুর কথা বলেন যেন, এখানেই তো আছেন, এ দিক ও দিকে! কোথাও যাননি, আমাদের মধ্যেই আছেন। প্রত্যেক বার যখন সুরকার-শিল্পীদের কথা ওঠে গুলজ়ার বলেন, ‘‘ও যাবে কোথায়? ওর গান, ওর সুর— সবই তো আমার মধ্যে আছে। যাওয়ার কথা তখনই মনে হয় তখন শূন্যতার সৃষ্টি হয়।’’ কবি-গীতিকার-পরিচালকের আরও মনে হয়, অনেক দিন কারও সঙ্গে কোনও কথা না হলে বা তার খবর না পেলে তখনই হৃদয়ে শূন্যতা তৈরি হয়। যিনি সব সময় আছেন, শিল্পীরা ওঁর গান করছেন, বন্ধুস্থানীয়েরা ওঁকে নিয়ে আলাপচারিতায় মগ্ন— সেই মানুষের যাওয়া তো নয় যাওয়া!
আবার শুধু যে আর ডি বর্মণের গানবাজনা নিয়ে কথা হচ্ছে তা নয়। ওঁর ভাল লাগা, মন্দ লাগা, কী কী গান উনি বেশি শুনতেন বা পছন্দ করতেন— অর্থাৎ ব্যক্তি রাহুল দেববর্মণও কিন্তু এই কথাবার্তায় থাকেন। এই জায়গা থেকেই তাঁর প্রিয় বন্ধু গুলজ়ার সাহেবের দাবি, “প্রচুর মানুষ দেখেছি। আর ডি বর্মণের মতো মানুষ লাখে এক জন। ওঁর অসাধারণত্ব, উনি নিজেই জানতেন না, তিনি কত বড় মাপের মানুষ। এটাও ওঁর বড় গুণ।” গুলজ়ার খুব কাছে থেকে দেখেছেন তাঁকে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, ভীষণ সরল-সাধাসিধে বলতে যা বোঝায়, সেটাই শচীন দেববর্মণের আদরের ‘পঞ্চম’। যে মানুষটির রক্তে শুধুই সুর আর সঙ্গীত। নানা ধরনের গানবাজনাও শুনতেন।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। গুলজ়ার সাহেবের থেকেই শুনেছি, কিশোর কুমারের সঙ্গে আর ডি’র এক ধরনের রফা ছিল। গানের সূত্রে কিশোরজি সারা বিশ্ব ঘুরতেন। প্রায় সব দেশের গানের রেকর্ড কিনে নিয়ে আসতেন। আর ডি তাঁর পথ চেয়ে বসে থাকতেন। কখন কিশোরজি মুম্বই ফিরবেন! তা হলে তাঁরা কিশোরজির বাড়িতে এক সঙ্গে বসে গান শুনতে পারবেন। কিশোরকুমারও সেই দায়িত্ব ভালবেসে পালন করতেন। বর্মণ পরিবারের সঙ্গে গায়কের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য সখ্য ছিল। যার জেরে শচীন দেববর্মণের মৃত্যুর পর পঞ্চমদাকে দেখে রাখার ভার অলিখিত ভাবে যেন এসে পড়েছিলেন গায়কের উপরে। কেউ বলেননি তাঁকে। গায়ক নিজেই অনুভব করেছিলেন। তিনিও তাঁর সাধ্যমতো আর ডি-কে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন।
আর ডি এ ভাবেই সারা বিশ্বের গান শুনতেন আর তাঁর গানে সেই সমস্ত সুর ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
পঞ্চমদার আরও একটি গুণ, তিনি ছাইচাপা প্রতিভা খুঁজে বের করতে পারতেন। যাঁকে খুঁজে বার করতেন তাঁকে কেউ চেনে না! পঞ্চমদার হয়তো তাঁর বাঁশি, মাউথ অর্গান বা গিটার শুনে ভাল লেগেছে। তিনি তাঁকে ডেকে এনে সুযোগ দিতেন। এ বার পঞ্চমদার সামনে বাজাতে হবে শুনে অনেকেই প্রচণ্ড ভয় পেতেন। সুরকার যতটা আশা করেছিলেন, ভয়ের চোটে ওই বাদ্যযন্ত্রী ততটাও ভাল হয়তো বাজাতে পারেননি। অন্য সুরকারেরা কী করতেন? তাঁকে বিদায় জানাতেন। রাহুল দেববর্মণ কিন্তু সে রকম কিছু করতেন না। তিনি আলাদা করে তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন। সময় দিতেন। এ ভাবে ভয় কাটিয়ে তাঁকে দলে টেনে নিতেন। এ ভাবেই তিনি একটি গানের পরিবার তৈরি করেছিলেন। শুনেছি পঞ্চমদা বলতেন, ‘কোনও প্রতিভা চটজলদি তৈরি হয় না। তাঁর সঙ্গে রেডিমেড হতে হয়। উভয়ের মধ্যে আদানপ্রদান সঠিক হতে হবে। প্রতিভাকে সকলের সামনে তুলে ধরার দায় আমাদেরও আছে।’
এই জন্যই ওঁর গানের আলাদা আকর্ষণ। পঞ্চমদার দলের প্রত্যেকে নতুন কিছু করার চেষ্টা করতেন। উনি সবাইকে বলে দিয়েছিলেন, ভুল হোক। তবু নতুন কিছু করার চেষ্টা যেন চলতে থাকে। বরং ভুল না করলে নতুন কিছু কোনও দিন জন্ম নেবে না। সকলে পরম নিশ্চিন্তে পঞ্চমদার উপরে নির্ভর করতেন। বিশ্বাস করতেন, তাঁরা ভুল করলে আর ডি বর্মণ দায়িত্ব নিয়ে শুধরে দেবেন। এই জন্যই প্রতিদিন পঞ্চমদার বাড়িতে নিয়মিত আড্ডা বসত, খাওয়াদাওয়া হত। তার মধ্যেই কাজ হত, গান তৈরি হত। সুরকারের এই গুণ প্রত্যেকের ভিতরে থাকা উচিত। আমিও কিন্তু এই শিক্ষায় শিক্ষিত।
যাঁরা ওঁর সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা হয়তো পরে অন্য সুরকারের সঙ্গেও কাজ করেছেন। কিন্তু, রাহুল দেববর্মণের প্রয়াণের পরে তাঁরা যেন ধীরে ধীরে গানবাজনা করার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্যই তাঁরা কাজ করতেন। কিন্তু পঞ্চমদার সঙ্গে কাজের যে মজা ছিল সেটা তাঁরা খুব ‘মিস’ করতেন। সে কথা নানা জায়গায় নানা ভাবে তাঁরা বলেছেন। আমার সঙ্গে অনেক বার ভূপিন্দর সিংহের কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘‘পঞ্চম চলে যাওয়ার পর খুব ফাঁকা লাগছে। আর সেই মজাটা নেই। সেই আবহ না থাকলে শিল্পীর পক্ষে কাজ করা খুব সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। পয়সাই তো সব নয়।’’ একা ভূপিন্দর নন, আরও অনেকে এই কথা বলেছেন।
ওঁদের কথা শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, সময় যখন যে কথা বলেছে সেটাই সঠিক। আর অধৈর্য হয়ে যাই।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা বলি। আমি তখন ‘পরিণীতা’ ছবির গানে সুর দিচ্ছি। পরিচালক-প্রযোজক বিধুবিনোদ চোপড়াজি বলেছিলেন, ‘‘যাঁর গান নিয়ে সারাক্ষণ আমাদের এত কথা, জন্মদিনে কত হই হই হয়, রেডিয়ো স্টেশনগুলোতে সকাল থেকে গান বাজানো হয়— সেই মানুষের গান সাত বছর কেউ শোনেনি! তখন এ কথাও রটেছিল, পঞ্চমদা যদি সুর দেন সেই ছবি চলবে না! সেই সময় অনেকে এসেছিলেন যাঁদের দেখে সাময়িক মনে হয়েছিল, তাঁরা বিরাট কিছু করবেন। সময় দেখিয়ে দিল কে সেরা।’’ যাওয়ার আগে ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’র গানে সুর দিয়ে পঞ্চমদা প্রমাণ দিয়ে গেলেন, তিনিই খাঁটি হিরে। আফসোস, নিজের চোখে সেটা দেখে যেতে পারলেন না।
আমারও আফসোস, আমি ওঁর সান্নিধ্য পাইনি। ওঁর ‘আনন্দ’, ‘ইজ়াজত’, ‘ঘর’ ছবির গানে ওঁকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি। ওঁর মতো হওয়ার চেষ্টা বা ইচ্ছা আমার নেই। পারবও না। ওঁর মতো মাটির কাছাকাছি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি। যে কখনও নিজের সম্বন্ধে সজাগ হবে না। শিল্পীদের জীবনে ‘ব্লকেজ’ আসে। ধৈর্য ধরে সেই খারাপ সময়কে পেরিয়ে যেতে হয়। শুনেছি, ‘লোকে আমার গান শুনছে না’র চেয়ে পঞ্চমদাকে বেশি কষ্ট দিত ওঁর বাড়িতে আর কেউ আসছেন না! কারণ, গানবাজনা বন্ধ। আড্ডা নেই। মানুষের আনাগোনাও নেই। এতটাই একাকিত্ব ঘিরে ধরেছিল তাঁকে যে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি।
অবশেষে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেল বিধু বিনোদ চোপড়ার ‘১৯৪২....’। ছবির প্রত্যেকটি গান হিট। পঞ্চমদা স্বমহিমায়। কিন্তু, তিনি সে সবের ঊর্ধ্বে। ওই বছরের জানুয়ারিতে চিরবিদায় নিয়েছেন। অনেককেই বলতে শুনেছি, পঞ্চমদা যদি আরও একটু থেকে যেতেন! আমার অনুভূতি, সঠিক সময়ে চলে গিয়েছেন সুরের জাদুকর। তাঁকে ভোলা যাবে না! আরও একবার প্রমাণ রেখে শেষ বিদায় নেওয়াই সম্মানের।