যিশু সেনগুপ্ত
বৃষ্টিমুখর দিনে গোয়েন্দার সাক্ষাৎকার সব সময় জমে। অবশ্য ‘গোয়েন্দা’ শব্দটা এ ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। তিনি সত্যান্বেষী। অঞ্জন দত্তের ‘ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ’-এ যিশু সেনগুপ্ত তৃতীয় বার সত্যান্বেষীর ভূমিকায়। দক্ষিণ কলকাতায় যে ক্লাবে সাক্ষাৎকার চলছিল, সেখানে বসেই ব্যোমকেশের সুযোগ পেয়েছিলেন যিশু। সমাপতন না কি কাকতালীয়?
প্র: এ বছর ‘পোস্ত’ সুপারহিট আর ব্যোমকেশ তো সফল ফ্র্যাঞ্চাইজি। তার মানে দুটো বড় হিট আপনারই ঝুলিতে?
উ: পরের বছর একটাও হিট না থাকতে পারে (হাসি)। তবে ব্যোমকেশের সাফল্যে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। অঞ্জনদা যেটুকু ব্যোমকেশ আমায় বুঝিয়েছেন, সেটুকুই করেছি। আর এই ফ্র্যাঞ্চাইজিটা আগে থেকেই সফল।
প্র: মানে যে কেউ ব্যোমকেশ করলে ছবি হিট হবে বলছেন?
উ: বাঙালি ব্যোমকেশ পছন্দ করে। অন্য পরিচালকের নির্দেশনাতেও ব্যোমকেশ সফল হয়েছে। ধৃতিমানদা (চট্টোপাধ্যায়) যে ব্যোমকেশ করেছিলেন, সেটাও ভালই চলেছিল। তবে ব্যোমকেশকে পরদায় আনার কৃতিত্বটা কিন্তু অঞ্জনদারই। সত্যজিৎ রায়ের ব্যোমকেশ দর্শকের কাছে সে ভাবে পৌঁছয়নি। আমার মতে, ওটা সত্যজিৎ রায়ের সেরা ছবিগুলোর মধ্যেও পড়ে না। অঞ্জনদা ব্যোমকেশকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। আমিও বোধহয় খুব একটা ঝোলাইনি (হাসি)!
আরও পড়ুন: আমার পাগলামি কম লোকই সহ্য করতে পারে
প্র: একটা সফল ফ্র্যাঞ্চাইজির অংশীদার মানে নিশ্চিত সাফল্য...এই ফ্লপের বাজারে আমার অন্তত একটা হিট আছে, এ রকমটা মনে হয়?
উ: ক’বছরের জন্য নিশ্চিন্ত? আমি ১৯ বছর ধরে এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছি। অভিনেতা কখনও নিশ্চিন্ত হতে পারে না। এটা আমার তিন নম্বর ব্যোমকেশ। অঞ্জনদা বোধহয় আর একটা ব্যোমকেশ করবেন কি বড়জোড় দুটো। তার পর কী হবে? আমি কোনও কিছুর উপর নির্ভর করি না। অঞ্জনদা মনে করতেই পারেন, এ বার অন্য কাউকে নিয়ে ব্যোমকেশ করবেন। যিশুকে আর মানাচ্ছে না। ‘ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ’-এই একজন কমবয়সি ব্যোমকেশ রয়েছে। কোনও কিছু আঁকড়ে থেকে লাভ নেই।
প্র: এই মানসিকতা কি আগের ১৯ বছরের অভিজ্ঞতার ফল?
উ: জীবনে দুটো জিনিস সত্যি— মৃত্যু আর বদল। ১৯ বছরের অভিজ্ঞতা আমাকে এটাই শিখিয়েছে। আমি যা যা কাজ করেছি, আমার সমসাময়িক কেউ সেটা করেনি। ভাল-মন্দ মিলিয়েই বলছি। আমার মতো সুযোগও কেউ পায়নি। আমার মতো খারাপও কারও সঙ্গে হয়নি। সিনেমা-সিরিয়াল-অ্যাঙ্করিং-থিয়েটার-যাত্রা করেছি। আর সবগুলোই সফল ভাবে। হ্যাঁ, সিনেমার ক্ষেত্রে হয়তো সময় লেগেছে। কিন্তু এখনও তো পরিচালকেরা ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, তোমার ডেট খালি আছে? এর চেয়ে বেশি কী চাইব? কাল কেউ ফোন না-ও করতে পারেন।
প্র: পরপর ব্যোমকেশ করতে ভাল লাগছে?
উ: লাগছে। (একটু থেমে) এই ক্লাবে বসেই আমি কৌস্তুভকে (রায়, প্রযোজক) বলেছিলাম, ব্যোমকেশ করতে চাই। তখন আবির বেরিয়ে গিয়ে ফেলুদা করছে। শুনলাম, অঞ্জনদা নতুন ব্যোমকেশের জন্য লুক টেস্ট করছেন। কৌস্তুভকে বললাম, ভাই, আমি তোর এত কাছের বন্ধু, একবার সুযোগ দে। ধুতি-পাঞ্জাবি-চশমা পরে অঞ্জনদার কাছে গিয়ে লুক টেস্ট দিতে চেয়েছিলাম। কোথাও একটা আত্মবিশ্বাস ছিল। অন্তত সরাসরি ‘না’ করে দিতে পারবেন না, এটা জানতাম। তখন কিন্তু অঞ্জনদা একজনকে ব্যোমকেশ হিসেবে নিশ্চিত করে ফেলেছেন। কৌস্তুভের অনুরোধ ফেলতে না পেরেই ডেকেছিলেন। অঞ্জনদার বাড়িতে লুক টেস্টের ছবি তোলার পর ওখানে বসেই চূড়ান্ত হয়ে যায়, আমি ব্যোমকেশ করছি। ব্যোমকেশের মধ্যে একটা ‘এজি’ ব্যাপার আছে। এক দিকে সে সংসারী, অন্য দিকে বন্দুক হাতে গুলি চালাচ্ছে। আবার প্রচণ্ড প্রোগ্রেসিভ। চরিত্রটার মধ্যে অভিনয় করার অনেক কিছু রয়েছে।
প্র: অঞ্জন দত্তের ব্যোমকেশ নিয়ে একটা অভিযোগও শোনা যায়। ছবির পরিধি খুব ছোট এবং গ্র্যাঞ্জার কম। মানবেন এ কথা?
উ: ‘ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ’ দেখলে কেউ আর এই অভিযোগ করবেন না। অঞ্জনদার বাকি ব্যোমকেশের চেয়ে এটা অনেকটা আলাদা। লার্জার দ্যান লাইফ। তবে অঞ্জনদার সব ক’টা ব্যোমকেশই ব্যবসায়িক দিক দিয়ে সফল। প্রযোজক টাকা ফেরত পেয়েছেন। হয়তো অনেকের ছবি দেখে মনে হয়েছে, আর একটু ভাল হতে পারত। পরের বার কিন্তু সেই লোকটা আবার হলে এসেছে। এর পর আর কী বলার থাকতে পারে! বাঙালিকে উনিই ব্যোমকেশের অভ্যেস ধরিয়েছেন।
যিশু সেনগুপ্ত
প্র: ব্যোমকেশ, ‘পোস্ত’র পাশাপাশি মসালা বাণিজ্যিক ছবি করতে ভাল লাগে?
উ: বছরে একটা নাচ-গান-মজার ছবি চলতা হ্যায়। খারাপ কী?
প্র: কিন্তু এমন একটা ছবির রিমেক করছেন, যেটা গত ১০ বছর ধরে টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। প্রতিটা দৃশ্য একই রকমের। এতে অভিনয় সত্তা সন্তুষ্ট হয়?
উ: আমি আপনার সঙ্গে একমত। তবে যে ছবিটার কথা বলছেন, সেটা কিন্তু দর্শক উপভোগ করেছেন। আর বাণিজ্যিক ছবি করে আমি অনেক বেশি টাকা পাই। কোনও অভিনেতা যদি বলেন, শুধু শিল্পের জন্য অভিনয় করেন, তা হলে মিথ্যে বলেন। দিনের শেষে টাকার প্রয়োজন আছে। অনেক ছবির জন্যই কম টাকা নিই। সেটা নিজের সন্তুষ্টির জন্য। কিন্তু বাড়িতে দুটো মেয়ে রয়েছে, সেটাও তো ভাবতে হবে। বা়ড়ি-গাড়ির ইএমআই আছে। সিনেমার জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার মতো সন্ন্যাসী এখনও হইনি।
প্র: এটাকে কি কেরিয়ারের গোল্ডেন ফেজ বলবেন?
উ: সে ভাবে ভাবিনি কখনও। একটা কাজের চেয়ে পরেরটা ভাল করাই লক্ষ্য। একটা হিট দিয়ে বসে রইলাম। তার পর বেশ কয়েকটা চলল না। এতে কিন্তু আমাকে কেউ মনে রাখবে না। আই ওয়ান্ট টু বি অ্যাট দ্য টপ। এর আগে যা হয়েছে, তা নিয়ে কোনও আফসোস নেই। তাতে লাভও নেই। আফসোস করলে কেউ দু’টাকা বেশি দেবে না।
প্র: আপনার মেয়ে সারা অভিনয় করছে। ও কি ভবিষ্যতে অভিনেত্রী হতে চায়?
উ: আমার খুব ইচ্ছে ছিল না, ও এখনই অভিনয় করুক। আগে পড়াশোনা করুক। আর ১১ বছরের মেয়ে এখনও বোঝেই না অভিনয় কী, স্টারডম কী। অন্তত আমি আর নীলাঞ্জনা যে ভাবে মানুষ করছি, তাতে বোঝার কথাও নয়। ও ফোটোগ্রাফি শিখছে। ভাল জিমন্যাস্টিক করে। যেটা ভাল লাগবে, সেটাই করবে। আমি বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষাটা পেয়েছিলাম, সেটাই ওকে দিতে চাই।