AI in Bengali music world

এআই-এর দৌলতে প্রয়াত শিল্পীর কণ্ঠস্বর ব্যবহার করেছেন রহমান, সঙ্গীতশিল্পীদের ভবিষ্যৎ কী?

প্রয়াত শিল্পীদের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে নতুন গান তৈরি করেছেন এ আর রহমান। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির নিয়মিত প্রয়োগের ফলাফল কী? মত জানালেন বাংলার বিশিষ্ট শিল্পীরা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:০০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কয়েক মাস আগে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানে নিজস্ব সুরারোপ করে দেশ জুড়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন। এ বার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রয়াত শিল্পীদের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে নতুন গান সৃষ্টি করেছেন এ আর রহমান। উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির দিকে ‘মিউজ়িক মায়েস্ত্রো’র এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু একই সঙ্গে তা দেশের সঙ্গীত জগতে একাধিক প্রশ্ন তুলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ব্যবহারে মূল স্রোতের সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ কী? এই ধরনের ব্যবহার কি আগামী দিনে শিল্পীদের ক্ষতি করবে? আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল বাংলা সঙ্গীত জগতের বিশিষ্টদের সামনে। উঠে এল নানা মত।

Advertisement

গত বছর তাঁর পেশাদার জীবনের তিন দর্শক সম্পূর্ণ করেছেন গায়ক নচিকেতা চক্রবর্তী। এই মুহূর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তিনি বিশেষ একটা আমল দিতে নারাজ। বরং পুরো বিষয়টাকেই তিনি ‘সময়ের ডাক’ হিসেবে উল্লেখ করতে চাইলেন। বললেন, ‘‘কম্পিউটার আসার আগে এক দল মানুষ হইচই করেছিল। কিন্তু কম্পিউটার তো আমাদের ক্ষতি করেনি। প্রয়াত শিল্পীদের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করেছেন মানে তো তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন। আমার মনে হয় না এতে কোনও সমস্যা হবে।’’ কিন্তু রহমানের মতো প্রবণতা যদি ভবিষ্যতে বাংলা সঙ্গীত জগতে প্রভাব বিস্তার করে তা হলে? নচিকেতার সাফ উত্তর, ‘‘ভবিষ্যতে কী হবে তা এখন বলা মুশকিল। এ আই আসার হলে আসবে। কিছু তো করার নেই।’’ একই সঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘আগে লাইভ মিউজ়িশিয়ানদের নিয়ে কাজ হত। এখন তো অনেকটাই প্রোগ্রামিংয়ে করা হয়। অনেকেরই কাজ চলে গিয়েছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিলে এগুলো তো হবেই। আমাদের তো সময় হয়ে এল। আগামী দিনে যাঁরা সঙ্গীত জগতে কাজ করতে আসবেন, তাঁদের একটু-আধটু অসুবিধা হলেও হতে পারে।’’ তবে শুধু সঙ্গীত জগৎ নয়, বিশ্বব্যাপী ‘এআই’ বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে অবগত নচিকেতা। বললেন, ‘‘এআই-এর বাড়বাড়ন্তে কত মানুষের চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে ভাবলে খারাপ লাগে। এআই-কে ঠেকাতে কিছুই হয়তো আমরা করতে পারব না।’’

ছবি: সংগৃহীত।

রহমানের ‘কীর্তি’ দেখে এখনই খুব বেশি ভয় পাওয়ার কোনও কারণ দেখছেন না সঙ্গীতশিল্পী অনুপম রায়। তাঁর সহজ যুক্তি, ‘‘কী হবে আর কোনটা হবে না, সেটা নির্ধারণ করার আমরা কেউ নই। আধুনিকতা এবং সমাজ যদি প্রয়াত শিল্পীর কণ্ঠস্বর শুনতে চায়, তা হলে সেটাই হবে।’’ অনুপম অবশ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক দিকগুলোর তুলনায় ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে বেশি উৎসাহিত। তাঁর কথায়, ‘‘টিভি বা ইন্টারনেট যখন এসেছিল, তখন তারও বিরোধিতা হয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন সকলে সেটা ব্যবহার করছি। এআই তো সঙ্গীতশিল্পীদের সাহায্যও করতে পারে। আগে থেকে তাই শুধু খারাপটাই ধরে নেওয়াটা ঠিক নয়।’’

Advertisement

অনুপম মনে করেন, এআই-এর নেতিবাচক প্রভাব সঙ্গীতের তুলনায় সমাজে এবং ব্যবহারিক জীবনে আরও বেশি। সেটা শিল্পী হিসেবে তাঁকে আরও বেশি ভাবায়। অনুপমের কথায়, ‘‘এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তি বদলে ফেলা হচ্ছে। সমাজমাধ্যম এবং হোয়াট্‌সঅ্যাপে তা ছড়িয়ে দিয়ে অগণিত মানুষকে প্রভাবিত করা সম্ভব! সেটা তো সঙ্গীতের তুলনায় আরও মারাত্মক।’’

ছবি: সংগৃহীত।

প্রয়াত শিল্পীর কণ্ঠস্বর ব্যবহার করেছেন বলে এ আর রহমানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে নারাজ গায়িকা ইমন চক্রবর্তী। তাঁর ধারণা, একটা ‘এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট’ হিসেবে রহমান গানটি তৈরি করেছেন। ইমন বললেন, ‘‘আমার মনে হয় না, রহমান আগামী দিনে এআই-এর সাহায্যে মহম্মদ রফির কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে গান তৈরি করবেন। এতটা অনুচিত কাজ উনি নিশ্চয়ই করবেন না।’’

শরীরে ‘রোগ’ বাসা বাঁধার আগে সাবধানতা অবলম্বন করায় বিশ্বাসী ইমন। শিল্পী বললেন, ‘‘খারাপ না কি ভাল, আমি এই তর্কেই যেতে চাইছি না। এআই যখন এসেছিল, তখন কেউ প্রতিবাদ করেনি। এখন আবিষ্কারের পর জানি না সেটাকে কী ভাবে থামানো যাবে।’’ ইমন জানালেন, ইউটিউব খুঁজলে অরিজিৎ সিংহ বা শ্রেয়া ঘোষালের ‘এআই’ সৃষ্ট গানের নমুনা পাওয়া যায়। পেশাদার পর্যায়ে রহমান প্রথম এই কাজটা করেছেন বলে হয়তো সকলে এখন নড়েচড়ে বসেছেন।

রহমান তাঁর কাজটি প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, দুই প্রয়াত শিল্পী বাম্বা বাক্য ও শাহুল হামিদের দুই পরিবারের তরফে তাঁদের কণ্ঠস্বর ব্যবহারের অনুমতি নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, গানটির জন্য দুই শিল্পীর পরিবারকে পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অনুমতি এবং পারিশ্রমিক— এই দুটো বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাইলেন সুরকার ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। তাঁর ধারণা, ‘‘শুরুতে বিষয়টা সহজ হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে কণ্ঠস্বর ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবারের অনুমতি পাওয়া যাবে না। আর পাওয়া গেলেও সেই পারিশ্রমিকটা এতটাই বেশি হবে যে এআই-এর বিষয়টা কোনও বাঁধাধরা নিয়ম হয়ে উঠবে না। কারণ, প্রত্যেকেই মনিটাইজ়েশন করতে চাইবেন।’’ সব ইউটিউব চ্যানেল থেকে যেমন সমান অর্থ রোজগার হয় না, প্রয়াত শিল্পীর কণ্ঠস্বর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিষয়টা সে রকম হতে পারে বলে মনে করছেন ইন্দ্রদীপ। সিনেমা থেকে উদাহরণ টেনে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বাংলা ছবির নাকি দর্শক কম। হিন্দি ছবির দর্শক বেশি। তার মানে কি বাংলা ছবি তৈরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? মাথায় রাখতে হবে কোনও কিছুই থেমে থাকে না।’’

ছবি: সংগৃহীত।

যে কোনও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা আছে বলে মনে করেন ইন্দ্রদীপ। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে শিল্পীদের রোজগারের উপর প্রভাব বিস্তার করবে, সে কথা সম্পূর্ণ মানতে নারাজ টলিপাড়ার এই সুরকার। ইন্দ্রদীপের যুক্তি, ‘‘কি-বোর্ডেও তো এক সময় সেতার-সরোদ বেজেছিল। কিন্তু তার ফলে কি সেতারবাদক, সরোদিয়া বা তবলিয়ার চাহিদা কমে গিয়েছে?’’ নতুন প্রযুক্তি এলে যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সাময়িক ধাক্কা আসে বলে মনে করেন ইন্দ্রদীপ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা মানুষ কাটিয়েও ওঠেন। ইন্দ্রদীপ বললেন, ‘‘কিশোর কুমারের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে হয়তো একটা গান তৈরি হবে। নিশ্চয়ই একাধিক তৈরি হবে না।’’ ভবিষ্যতে আরও উন্নত নতুন কোনও ‘খেলনা’ এলে, তখন এআই-কেও মানুষ ভুলতে শুরু করবেন বলেই আশাবাদী ইন্দ্রদীপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন