বাঙালির জীবনে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রভাব নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। তা সে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান হোক, বা ঘটি-বাঙাল। বাম-ডান থেকে ঋত্বিক-সত্যজিৎ। আর এই দ্বন্দ্ব যখন রোববারের সকালে রীতিমতো প্রেশার কুকারের তিনটে সিটি দিয়ে মন-কেমন-করা গন্ধ ছড়ায়, তখন আমরা বলে উঠি : লেদার, না ফেদার? অর্থাৎ মেনুতে আজ মাটন, না চিকেন?
কথাটা প্রথম যখন শুনেছিলাম, তখন আমাদের প্রথম যৌবন। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিটের মোড়ে পাড়ার দাদাদের আড্ডায়। গতকালের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের ঝাঁঝ মিলিয়ে যেতে না যেতেই রোববারের গড়িয়ে যাওয়া দুপুরের মেনুকে এমনই রসিক সম্বোধনে ডাকা হতো সেই সময়। এটা সেই সময়, যখন কচি পাঁঠার ঝোলের ওপর ডাক্তারবাবুর নিষেধাজ্ঞা চাপেনি। এবং ব্লাডসুগারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বড় ডুমো ডুমো নরম আলু আর গোটা পেঁয়াজ সেই ঝোলে স্বমহিমায় বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, বরফ-ঠান্ডা স্বাদের ব্রয়লার নয়, চিকেন মানে তখন দেশি মুরগি ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই হতো না। বাঙালির রোববারগুলো জড়িয়ে ছিল এমনই এক অমোঘ ডিসিশন মেকিং-এ—লেদার, না ফেদার?
কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার গল্প তো এ কালের স্বাস্থ্যসজাগ বাঙালিদের কাছে রূপকথার মতো। জিম-রেজিমের দাপটে আজ আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি সেই সব রসময় বেহিসেবি ভোজ। এখন আর তেমন রয়ে-সয়ে রান্নার সময়ই বা কোথায়! কই সেই তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়ার ফুরসত! বাঙালির রোববার এখন শনিবার রাতের হ্যাংওভার, আর মনডে মর্নিং ব্লু-এর মাঝে স্যান্ডুইচ হয়ে গেছে। আজকালকার শহরে তেমন কেমন-করা সিটিই বা পড়ে ক’টা? নিঃশব্দ মাইক্রোওয়েভ বাঙালিকে আজ শান্ত করে রেখেছে।
সাড়ে তিনশো, কী বাজারবিশেষে চারশো টাকা কিলো খাসির মাংস আজ অনেকেরই নাগালের বাইরে। তবু সেদিনও হতো, আজও সেই দোকানের লাইনে জনা দশেকের পর দাঁড়াতে হয়। আর চির-খুঁতখুঁতে বাঙালির সিনা, না রাং—এই দ্বন্দ্ব মিটতে মিটতে পেছনে আরও দশজন সেই লাইনে ভিড় জমায়। মুরগির দোকান অবশ্য সেদিক থেকে যাকে বলে ওয়েল ডিফাইনড। বেশি অপশন নেই, শুধু একটাই মোক্ষম কাট— কাটা না গোটা? বাঙালির অর্ধেক জীবন যে বাজারেই কেটে যায়, সেটা তো খুব ভুল কথা নয়। অবশ্য আজকের বাঙালিবাবু এয়ারকন্ডিশন্ড মলে শপিং কার্ট ঠেলে ঠেলে বাজার করছেন, কাদা প্যাচপেচে পায়ে এ-দোকান সে-দোকান করতে ভারি বয়ে গেছে। ঠিক যেমন, একালের বাঙালি দরাদরিতেও অতটা দড় নয়। বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি-তে তাঁর আধুনিক বাজারযাপন।
তাই লেদার, না ফেদার, এই রোম্যান্টিসিজম হয়তো আর তাঁকে ঘায়েল করে না। সে আজ বুধ-বিষ্যুৎবারেও মাটন বা চিকেন সেবন করে থাকে। রোববারের সকালের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকার কোনও মানেই হয় না তাঁর কাছে। ছুটতে থাকা সময়ের প্রেশার কুকারে কখন তাঁর নিজেরই যে তিনটে সিটি পড়ে গেছে, সে টেরও পায় না।