শায়ান চৌধুরী অর্ণব। ছবি: সংগৃহীত।
‘কোক স্টুডিয়ো বাংলা’র রূপকার। কিন্তু তাঁকে নিয়ে অনুরাগীদের কৌতূহলের অন্ত নেই। শহর পছন্দ নয়, সমাজমাধ্যমের অতিসক্রিয়তার যুগে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে দু’-তিন মাস ফোন ছাড়াই কাটিয়ে দিতে পারেন। সংসার করেও নিজেকে সংসারী বলতে নারাজ। কলকাতার ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ বাংলা গান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, শান্তিনিকেতনে কাটানো নানা মুহূর্ত, জীবনের পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে অকপট শায়ান চৌধুরী অর্ণব।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে ব্যস্ততা কেমন?
অর্ণব: কিছু দিন আগে বিদেশে অনুষ্ঠান করে ফিরলাম। এর মধ্যে আমার নতুন অ্যালবাম ‘ভাল লাগে না’ মুক্তি পেয়েছে। সেটার ভিডিয়ো শুট, সব নিয়ে বেশ ব্যস্ততা।
প্রশ্ন: এই অ্যালবামটা প্রথম, যেখানে সবকটাই আপনার নিজস্ব গান। লোকে তো রবীন্দ্রনাথের গানকে আপনার গান ভেবে ভুল করেন?
অর্ণব: ঠিক বলেছেন। ‘মাঝে মাঝে তব’ গানটা লোকে অর্ণবের গান ভেবে বসেছিলেন। অনেকে আপত্তি জানিয়েছেন। আসলে যাঁরা গোঁড়া তাঁরা ভেবে বসেছেন, আমি হয়তো এই গানটা নিজের বলে দাবি করছি। সেটা কিন্তু নয়। যে বা যাঁরা এ সব প্রচার করছেন সেটা তাঁদের বিষয়। সেখানে তো আমার কোনও হাত নেই।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের গান, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে জড়িয়ে আপনি। যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত গিটার বাজিয়ে গাইলেন, তাতেই কি ক্ষুণ্ণ হল বাঙালি?
অর্ণব: রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার নির্দিষ্ট ধরন আছে। কিন্তু আমরা ছোটবেলায় স্কুলে যখন গান শিখতাম, সব সময়ে স্বরলিপি মেনে যে গাওয়া হত তা নয়। গলা ছেড়ে গান গাওয়া শিখেছিলাম। আবার স্বরলিপি মেনেও গান গাওয়া শেখানো হত শান্তিনিকেতনে। আমি শান্তিদেব ঘোষের ছাত্র বিজয় সরকারের কাছে গান শিখেছি। তাঁর ধরনটাই ছিল লয় বাড়িয়ে গলা ছেড়ে গান। অনেকেই ভাবেন, শান্তিনিকেতনের শিক্ষকেরা গোঁড়া। আমাকে কিন্তু সকলে বরাবর উৎসাহ দিয়েছেন।
প্রশ্ন: আপনি গায়ক, মিউজ়িক প্রোডিউসার, সুরকার, অ্যারেঞ্জার। নিজে কোন কাজটা করে তৃপ্তি পান?
অর্ণব: আমি তো গাইতে পারি না। তাই যখন সুর করি, যখন কোনও গান অ্যারেঞ্জ করি তখন আনন্দ পাই।
প্রশ্ন: সে কি! আপনার গানের এত গুণমুগ্ধ শ্রোতা আছে যে!
অর্ণব: সে আছে, মানে দর্শক আমার উপস্থাপনাটা পছন্দ করেন। কিন্তু আমি তো সে ভাবে প্রথাগত শিক্ষা নিইনি গানের। স্কুলে এসরাজ বাজানো শিখেছি। বাকিটা শান্তিনিকেতনে শুনে শুনে শিখেছি।
প্রশ্ন: অনেকসময় আপনার সুর এদিক-ওদিক হওয়া নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেছেন
অর্ণব: না, আমি তেমন কিছু শুনিনি। সব সময়ে প্রশংসাই শুনেছি।
প্রশ্ন: অর্ণব তো দুই বাংলায় খুব জনপ্রিয়, কলকাতায় এত কম কাজ করেন কেন?
অর্ণব: আসলে ঢাকায় খুব ব্যস্ততা থাকে। কোক স্টুডিয়োর কাজ এক দিকে। তার পর কখনও আমেরিকা যাচ্ছি অনুষ্ঠান করতে, কখনও আবার অস্ট্রেলিয়া। এ ছাড়াও, এখনও দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে তাতে ভিসা পাওয়াটা একটা সমস্যা। কাজ করছি না, এমনটা নয়। আমাকে ডাকলেই করব।
প্রশ্ন: আপনি কিন্তু দুই দেশের মাঝে সম্প্রীতির প্রতীক হতে পারতেন।
অর্ণব: (হা হা) হতে হয়তো পারতাম। আসলে আমার ১৭ বছর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাই একটা সত্তা তো আছে সেখানকার। ঢাকায় সবাই গানের বন্ধু, কর্মজীবনের বন্ধু। শান্তিনিকেতনে প্রাণের বন্ধু, ছোটবেলার বন্ধুদের খুব মিস্ করি।
প্রশ্ন: শৈশব, কৈশোর, যৌবন সবই শান্তিনিকেতনে। ওখানকার কোন স্মৃতিটা ভোলার নয় আপনার কাছে?
অর্ণব: আমি শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিকে বড্ড মিস্ করি। ওখানে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে রেখেছিলাম। একটা সময়ে ঘন ঘন সেখানে যেতাম আমি। তখন বেশ কিছু কাজ করেছি ওখানে। মুর্শিদাবাদির সঙ্গে কাজ করেছি, সুনিধির সঙ্গেও সেই সময়ে কাজ করা হয়েছে। এখন সোনাঝুরি চেনা যায় না। ভীষণ ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: সোনাঝুরিতে কোনও সুখস্মৃতি আছে?
অর্ণব: স্কুলে পড়ার সময়ে বন্ধুরা মিলে সেখানে পিকনিক করতে যেতাম। সেটা মনে পড়ে। শান্তিনিকেতনের যে বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, সেটা দেখে খারাপ লাগে।
প্রশ্ন: শিল্পী হিসেবে বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কতটা সহজ ?
অর্ণব: যা কিছু পুরনো ছিল বড্ড মিস্ করি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সব বদলে যায়, সেটা মেনে নিতে হয়। আসলে শুধু শান্তিনিকেতন নয়, আমাদের দেশেও তো একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। হয়তো ভাল কিছু হবে, এই আশা রাখছি।
প্রশ্ন: নিজের দেশের পরিস্থিতি দেখে উদ্বেগ হয়?
অর্ণব: হ্যাঁ, খুবই হয়। আসলে সব সময় প্রকাশ করা যায় না। তবে উদ্বেগ হয়।
প্রশ্ন: মাঝে অরিজিৎ সিংহের বাড়ি গিয়েছিলেন। কেমন লাগল ওঁকে?
অর্ণব: একটা কাজের কথা বলতে গিয়েছিলাম। ওকে ঠিক আমার মতো মনে হয়। একদম সাধারণ ভাবে থাকতে ভালবাসে। খুব ভাল ছেলে। মুর্শিদ নিয়ে গিয়েছিল আমাকে ওর বাড়িতে। অরিজিৎ জিয়াগঞ্জে যে ভাবে থাকে, শান্তিনিকেতনে গেলে আমিও এ ভাবেই থাকি। আমি খুব লাজুক স্বভাবের মানুষ, ও চুপচাপ ধরনের। খুব প্রয়োজন না হলে কথা বলে না।
প্রশ্ন: অর্ণবের রাগ হয়?
অর্ণব: হ্যাঁ, রাগ হয়। রেগে গেলে চিৎকার করে দিই। তবে সেটা কিন্তু বছরে এক বারই। এমনিতে ঠান্ডা স্বভাবের।
প্রশ্ন: ‘কোক স্টুডিয়ো বাংলা’র নেপথ্যের কারিগর আপনি। কাজ শুরুর আগে কী চিন্তাভাবনা ছিল?
অর্ণব: আসলে যখন কাজটা শুরু করি তখনই ভেবেছিলাম আগে শিল্পী নয়, গান বেছে নিই। তার পর দেখি কাকে দিয়ে গাওয়াব। তবে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনাও আছে। আমাদের কাছে শিল্পীর থেকে গানটাই প্রধান। তার পর কোন গানের সঙ্গে কোন গান মেলানো হবে, কোন শিল্পী কী ধরনের গান গাইবে... লম্বা একটা প্রক্রিয়া।
প্রশ্ন: অনুষ্ঠান শুরুর আগে প্রস্তুতির জন্য কতটা সময় নিয়েছিলেন?
অর্ণব: প্রথম সিজ়ন শুরু হওয়ার আগে মাত্র দু’মাস সময় দেওয়া হয়। পরের সিজ়ন থেকে প্রীতম হাসান-সহ অন্য মিউজ়িক প্রোডিউসাররা কাজটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, ফলে আমার চাপ কিছুটা কমে। প্রথম সিজ়নটা পুরোটা একা করতে হয়। তবে প্রথম থেকে আমার সঙ্গে ছায়াসঙ্গী ছিল আদিত ও শুভেন্দু শুভ।
প্রশ্ন: শিল্পী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটা কেমন হয়?
অর্ণব: আমাদের গোটা একটা টিম আছে যাঁরা এই কাজটা করেন। আমরা নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গান চালাচালি করি। সে ভাবেই ‘দিলারাম’ গানটা পাই। তার পর দেখলাম, আমার একটা গানের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সে ভাবেই তৈরি।
প্রশ্ন: কোক স্টুডিয়ো ভারত, নাকি কোক স্টুডিয়ো পাকিস্তান, কাদের গান নিজে শোনেন?
অর্ণব: কোক স্টুডিয়ো পাকিস্তানের গানে ভীষণ অনুপ্রাণিত হই। ওদের বাজেটও অনেক। কোক স্টুডিয়ো ভারত? ওই আর কী। কোক স্টুডিয়ো ইন্ডিয়া তো আমাদের অনেক আগে শুরু করেছে। আগে অনেকে যুক্ত ছিলেন। এখন ওদের কাজের ধরন বদলেছে, নাম বদলেছে। খানিকটা মানও মনে হয় পড়েছে।
প্রশ্ন: কলকাতার কোন শিল্পীদের গান ভাল লাগে?
অর্ণব: আমার সমসাময়িক রূপম ইসলাম, অনুপম রায়ের গান ভাল লাগে। আমার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনতে ভাল লাগে। কলকাতায় এটার চর্চা হয়। যদিও ইদানীং কালে সারা ভারতে বলিউডের গানের এমন চাপ যে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট গান’ সেই প্রচার পাচ্ছে না। আমি তাঁদের গান আরও বেশি করে শুনতে চাই।
প্রশ্ন: কলকাতায় ইন্ডিপেনডেন্ট গান-বাজনার জায়গাটা বাংলাদেশের তুলনায় কেমন লাগে?
অর্ণব: ছোটবেলায় আমরা কিন্তু কবীর সুমন, নচিকেতা, মহীনের ঘোড়াগুলি শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু কলকাতায় এখন জায়গাটা কেমন বদ্ধ হয়ে আছে। সেখানে বাংলাদেশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গান লিখছে, গান বানাচ্ছে, সুর দিচ্ছে। ‘যদি বিরহ থাকে’ গানটা কী সুন্দর বানিয়েছে অঙ্কন। এখানে অনেক নতুন ট্যালেন্ট খুঁজে পাচ্ছি। আসলে ভারতে ইন্ডিপেনডেন্ট গান প্রচারের জন্য পর্যাপ্ত স্পনসর নেই। আমার ‘ভাল লাগে না’ অ্যালবামটার যদি স্পনসর না পেতাম, একা গান বার করে, মিউজ়িক ভিডিয়ো তৈরি করা, মিউজ়িশিয়ানদের টাকা দেওয়া এই এত কিছু করা সম্ভব হত না। একটা সাপোর্ট দরকার। সেটার মনে হয় ঘাটতি রয়েছে।
প্রশ্ন: ‘কোক স্টুডিয়ো’র তৃতীয় সিজ়নে আপনার উপস্থিতি তেমন দেখা যাচ্ছে না কেন?
অর্ণব: আমি ‘তাঁতী’ গানটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আসলে আমার উপর এত দায়িত্ব থাকে যে কম্পিউটারের সামনে বসার সুযোগ পাচ্ছি না। আমি ঝাড়া হাত-পা থাকলে অন্যদের পরিচালনা করতে সুবিধে হয়। নিজেকে একা সবটা করতে গেলে একটা জ়োনে ঢুকতে হয়।
প্রশ্ন: এত ব্যস্ততার মাঝে সুনিধির সঙ্গে সংসার কতটা করা হচ্ছে?
অর্ণব: জানি না, কতটা সংসার করতে পারছি। চেষ্টা করছি। তবে সব দায়িত্বই সুনিধির কাঁধেই।
প্রশ্ন: ইদানীং ভারতীয় তারকাদের অনেকেই ‘নেপোটিজ়ম’ বিতর্কে বিদ্ধ হন। সুনিধিকে নিয়ে আপনাকে তেমন কিছু শুনতে হয়েছে?
অর্ণব: না, ও খুব ভাল গায়িকা। আমরা সকলেই এই বিষয়ে সহমত হয়েছি বলেই ওকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর সুনিধি আমার থেকে ভাল গায়। তাই দর্শক ওকে সহজে গ্রহণ করে নিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার মহিলা অনুরাগী সংখ্যা তো অনেক! স্ত্রী কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন?
অর্ণব: না না, বরং উৎসাহ পেয়েছি ওর কাছ থেকে। বাংলাদেশে যখন অনুষ্ঠান করি, তখন ওরা গান করতে দেয় না আমাকে। নিজেরাই সব গান গাইতে থাকে। একসঙ্গে কথা বলা যায় না। কিন্তু গান গাওয়া যায়।
প্রশ্ন: কলকাতা কেমন লাগে?
অর্ণব: শহর খুব একটা ভাল লাগে না। এত গতি, সকলে ছুটছে। শান্তিনিকেতনে যেমন সাইকেল চালিয়ে ঘুরতে পারি, নিজের মতো থাকতে পারি। যদিও কলকাতার রাস্তাঘাট ভাল লাগে।
প্রশ্ন: এখন নাকি যন্ত্রের সাহায্যে যে কেউ গায়ক-গায়িকা হতে পারেন?
অর্ণব: বেসিক গানটা গাইতেই হয়। আমরা যন্ত্রের সাহায্যে একটা ভুল শুধরে দিতে পারি। যন্ত্র কখনও গায়ক-গায়িকা তৈরি করতে পারে না।
প্রশ্ন: শিল্পীদের বর্তমান সময়ে সমাজমাধ্যমে উপস্থিতি কতটা প্রয়োজন?
অর্ণব: আমি নিজের ব্যক্তিগত জীবন প্রকাশ্যে আনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। আর সমাজমাধ্যমের খুব প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। আমি আমেরিকায় গিয়ে দু’মাস ফোন ব্যবহার করিনি, ফোনে চার্জ ছিল না। তার পর চার্জ দিইনি। ফোন ব্যবহারও করিনি। কারও প্রয়োজন হলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেয়। আমার মনে হয়, শিল্পীদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম— এ সবের থেকে দূরে থাকাই ভাল। আর লোকের কমেন্ট পড়ি না। এগুলো অপ্রয়োজনীয়।