কয়েকটি সিরিজ়ে আঁধারের বাহক ভারতীয় পুরাণ
Bollywood

বিদেশি সিরিজ়ের মতো ভারতীয় ওয়েব কনটেন্টও আঁধারে ঘেরা

‘সেক্রেড গেমস’-এর প্রথম সিজ়ন, ‘অসুর’, ‘আফসোস’-এ আঁধারের বাহক ভারতীয় পুরাণ।

Advertisement

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২০ ০১:৩২
Share:

‘সেক্রেড গেমস’

রাত যত বাড়ে, ‘বিঞ্জ ওয়াচ’ করার প্রবণতাও বাড়তে থাকে দর্শকের মধ্যে। বাইরে আঁধার, স্ক্রিনে ডার্ক কনটেন্ট আর মনের অচেনা অন্ধকার মিলেমিশে বোধহয় এক অদ্ভুত মোহজাল তৈরি করে। এই ফ্যাক্টরগুলিকে বাজি ধরেই একের পর এক ডার্ক কনটেন্টের সিরিজ় জাঁকিয়ে বসছে নেটফ্লিক্স-অ্যামাজ়নের দুনিয়ায়। বিদেশি সিরিজ়ের ধারাকে অনুসরণ করে ভারতীয় কনটেন্টেও ‘অন্ধেরা কায়ম রহে’র জয়জয়কার। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তিপ্রাপ্ত সিরিজ় ‘হসমুখ’ এক স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানের গল্প। কিন্তু তার ছত্রে ছত্রে রক্তপাতের চাপা উল্লাস। অ্যামাজ়ন প্রাইমের নতুন সিরিজ় ‘পাতাল লোক’ ডার্ক থ্রিলার, নেটফ্লিক্সের আসন্ন সিরিজ় ‘বেতাল’ একটি জ়ম্বি ড্রামা। এই ধারার পথপ্রদর্শক নেটফ্লিক্সের প্রথম ভারতীয় অরিজিনাল সিরিজ় ‘সেক্রেড গেমস’। এর পরে সুজয় ঘোষের ‘টাইপরাইটার’, অনুভূতি কাশ্যপের ‘আফসোস’, অনি সেনের ‘অসুর’... সবেরই মূল সুর মানুষের মনের আঁধার। শুধু গল্প বলার মোড়ক আলাদা।

Advertisement

এর মধ্যে ‘সেক্রেড গেমস’-এর প্রথম সিজ়ন, ‘অসুর’, ‘আফসোস’-এ আঁধারের বাহক ভারতীয় পুরাণ। ‘আফসোস’-এ পুরাণের সঙ্গে মিথ এবং ভারতীয় ইতিহাসকেও কায়দা করে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমসময়ের রাজনীতি, ধর্ম, বৈষম্য এবং এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হিংসা হিন্দি সিরিজ়ের ক্ষেত্রে একটি নতুন জঁর তৈরি করেছে। ব্যক্তিমনের অন্ধকারের সঙ্গে সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক আঁধারের মিলন ঘটাতে কিছু ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করছে পুরাণ। এই ধারাই কি ভারতীয় ওয়েবের ভবিষ্যৎ?

Advertisement

আঁধারের প্রতি ঝোঁক কেন?

পরিচালক মৈনাক ভৌমিক এই ট্রেন্ডের টেকনিক্যাল দিকটি তুলে ধরলেন, ‘‘সিনেমার দু’ঘণ্টার বদলে যখন ওয়েব সিরিজ়ে সাত-আট ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়, তখন মানব চরিত্রকে বহুমুখী করে তুলতে হয়। এবং তা আর সাদা-কালোর সরলরেখায় চলে না। যে কোনও চরিত্র যত বেশি ধূসর হবে, তার মধ্যে ডার্কনেস কোশেন্টও বাড়বে। দর্শক এর সঙ্গে রিলেট করেন বেশি, কারণ ডার্ক রূঢ় বাস্তব।’’ একই মত পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের, ‘‘সিনেমার চেয়ে সিরিজ়ের পরিসর বেশি। তাই চরিত্র বিশ্লেষণের জন্য ডার্কনেসের দিকে ঝুঁকতে হয়।’’

দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ট্রেন্ডের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বিশ্লেষণ করলেন গুপ্তধন সিরিজ়খ্যাত চিত্রনাট্যকার শুভেন্দু দাশমুন্সি, ‘‘ওয়েব প্ল্যাটফর্মে কমিউনিটি ওয়াচ কমই হয়। তাই একলা মনে এই সিরিজ়গুলির অন্ধকার বেশি করে নাড়া দেয়। যে ব্যক্তিমন তার অন্ধকার লুকিয়ে রাখতে পারে, সোশ্যাল নেটওয়র্কিং সাইটে নিজেকে আড়ালে রেখে অন্যকে ট্রোল করতে পারে, সেই একা মনের সঙ্গে সিরিজ়ের যেন একটা কথোপকথন চলে।’’ অন্ধকারের প্রতি মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার, মত পরিচালক অরিন্দম শীলের। ‘‘রক্ত, নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখে মানুষ বলবে। তবু দেখবে। তা নিয়ে আলোচনাও করবে,’’ বললেন পরিচালক।

পুরাণের প্রতি নির্ভরতা কেন?

‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’-এর অভাবনীয় সাফল্যের পরে ভারতীয় পর্দায় পুরাণ বলতে ‘বাবা তারকনাথ’ বা ‘জয় সন্তোষী মা’র মতো ছবি। কিন্তু ওয়েব সিরিজ় ভারতীয় মিথ ও পুরাণের উপরে অন্য গুরুত্ব আরোপ করেছে। শুভেন্দুর মতে, ‘‘পুরাণ আধারের মতো। প্রতিটি মানুষ তাকে তার সময়ে দাঁড়িয়ে ডিকোড করে। একটা সময়ে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ‘মরালিটি’র সংযোগ তৈরি হয়েছিল। যার জন্য ‘বাবা তারকনাথ’-এর মতো ছবি হয়েছে। একবিংশ শতকের শুরু থেকেই পুরাণকে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ নানা ভাবে দেখছেন। সমকালীন রাজনীতি পুরাণের প্রতি আগ্রহ তৈরি করেছে। তাই নতুন ‘ক্রিয়েটিভ মিথ’ খোঁজার চেষ্টা চলছে।’’

অরিন্দমের মতে, ‘‘ভারতীয় পুরাণে অন্যায় জাস্টিফাই করার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। রক্ততৃষ্ণাও রয়েছে।’’ পরমব্রত মনে করেন, ‘‘মহাভারত-রামায়ণ, পুরাণ যেমন ঠিক-ভুলের বিভাজন করে দেয়, আবার ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতেও শেখায়।’’ মৈনাক সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি দেখছেন, ‘‘নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজ়নের আন্তর্জাতিক দর্শকের কথা মাথায় রেখে ভারতীয় কনটেন্টের ক্ষেত্রে পুরাণকে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে। কারণ ভারত তৃতীয় বিশ্বের এমন একটি দেশ, যার ইতিহাস, গুপ্তবিদ্যা, মিথ, প্রাচীনত্ব এখনও পশ্চিমের মনে কৌতূহল তৈরি করে।’’

এই ট্রেন্ড কি এখন তবে ওয়েবে রাজত্ব করবে? সময় দেবে তার উত্তর। কারণ ব্যস্ত মানুষের অশান্ত মনকে স্ক্রিনে আটকে রাখতে এই জঁর অনেকাংশেই সফল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন