‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’য়ের একটি দৃশ্য
সিনেমার পর্দায় তখন বড় হওয়ার আকাশে টুকরো টুকরো মেঘের মতো নানা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। একসঙ্গে প্রথম সিনেমা দেখা, সিগারেটে সুখটান দেওয়া। ক্লাসে কথা বলে শাস্তি পাওয়া। টিউশন ‘বাঙ্ক’ করে গার্লস স্কুলের সামনে অকারণ ঘোরাফেরা। তখন মনে হয়েছিল, এই দিনগুলো বুঝি কখনও ফুরোবে না। পর্দায় চোখ রেখে বিভোর মানুষগুলোর মন তখন মাল্টিপ্লেক্সের ঠান্ডা ঘর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে কোনও এক আদর গায়ে মাখা বিকেলে। অন্য সময় হলে, সিনেমা শেষ হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তেন। আজ যেন কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। পর্দায় তখন টাইটেল কার্ড আর সঙ্গে…. বন্ধু চল… গানটি। মনে একটাই প্রশ্ন। আজও কি হাঁক পাড়লেই বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়াবে?
‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ দেখে এই অনুভূতি হয়েছে অনেকেরই। নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন। ফেসবুকে স্কুলজীবনের ছবি আপলোড করেছেন। মনে পড়ে যাচ্ছে স্কুল-কলেজের শেষ দিনের কথা। গোধূলি লগ্নে বন্ধুকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট গলার কাছে যখন কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল, তখন বন্ধুর হাত ধরে অঙ্গীকার করেছিলেন একসঙ্গে থাকার। তার পর রাস্তা দিয়ে কত ধুলো উড়ে গেল। কত নতুন হাইরাইজ মাথা তুলল। কত মানুষের মুখ ভিড় করল আপনার জীবনে। পাল্লা দিয়ে চলল দৌড়। ইলেকট্রিক তারের ওপর জমা জল যেমন বিন্দু বিন্দু মাটিতে ঝরে পড়ে, সে ভাবেই বন্ধুত্বের চরম ভালবাসাও ঘনত্ব হারায়।
অথচ এই নিরন্তর ছোটাছুটি শুরু হওয়ার আগেই আপনার বন্ধুরা, আপনার জীবনে এসেছেন। যেখানে ছিল না কোনও অস্পষ্টতা, কোনও দ্বিধা। সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্রের কথায়, “বন্ধুত্বের শুরুতে আসলে আমরা স্বার্থ নামক অনুভুতির সঙ্গে পরিচিত হই না। তাই ভিতটা হয় খুব মজবুত।’’ মানসিকতাই বন্ধুর দোষত্রুটি নিজের কাঁধে নিতে প্রেরণা দেয়, এমন কিছু বন্ধুর কথা মনে পড়ে পরিচালক সুজিত সরকারের। “ওই রকম বিনা শর্তে পাশে আর কেউ দাঁড়ায় না।’’ তাঁর স্কুলের এক বন্ধুর সঙ্গে সুজিতের খুব সম্প্রতি যোগাযোগ হয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে। তা হলে কি ফেসবুকই সেই মাধ্যম, যার দ্বারা বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা যায়? না হলে আপনি কী করেই বা জানবেন ক্লাসে যার টিফিন প্রায় নিয়ম করে খেয়ে ফেলতেন আপনার সেই বন্ধুই এখন বসবাস করছেন নিউ ইয়র্কে। অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় অনেক দূরের বন্ধুদের এ ভাবেই কাছে পেয়েছেন, যোগাযোগও হয়েছে।
তবে বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা না হলে যেন ঠিক মন ভরে না। কিন্তু দেখার উপায় না থাকলে? “তখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটই ভরসা” বলছেন ‘আগন্তুক’এর যুক্তিবাদী অভিনেতা। কিন্তু অনেক সময়ই তো আমরা বন্ধুদের টেকেন ফর গ্র্যান্টেড করে ফেলি! সুজিতের মনে হয়, তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে তো সময়ও দিতে হয়। তার পরেও যদিও রয়েছে এক অনাবিল সত্য। তা হল, বন্ধুত্বের সেনসেক্সে ঊর্ধ্বগতি আছে। নিম্নগতি নেই। বন্ধুত্বের পারদ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আবার কবে, তাতে উষ্ণতার ছোঁয়া লাগবে। না হলে পরিচালক অপর্ণা সেনের পাঁচ বন্ধু, যাঁরা আজও পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে পরিচিত, কী ভাবে নিজেদের বন্ধুত্বের ৪০-তম অ্যানিভার্সারি সেলিব্রেট করতে পারেন। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কতটা মজবুত বলতে গিয়ে উচ্ছ্বাস স্পষ্ট তাঁর গলায়। অপর্ণা বলেন, “এই তো সেদিন কলেজের বন্ধুরা মিলে রায়চক বেড়াতে গেলাম। গল্প, আড্ডা দিয়ে কী দারুণ সময় কাটল!’’
সঙ্গীতশিল্পী কৌশিকী চক্রবর্তী যেমন বাড়িতে বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেন, বা বন্ধুদের বাড়ি যান। “অনেক হুজ্জুতি করি, গান, গল্প, ডাম্বশরাড খেলা সবই হয়।’’ তবে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেলফি তোলেন না। বন্ধুত্ব তো একান্ত আপন সেই বহুমূল্য উঠোন, যেখানে খেলতে খেলতে কাদা মেখেও আপনি পরিষ্কার। খুব মানবিক একটা সম্পর্ক। ছবিতে ক’টা লাইক পড়ল, তা দিয়ে কীই বা গেল এল বলুন তো?
তাই হা-হুতাশ না করে বাস্তবে পা রাখুন। বলুন তো, বন্ধুত্বের ডায়েরি, কত বার উল্টে দেখেছেন এই ক’বছরে? জীবনে তো কত আপস করেন। বন্ধুদের একটু ছাড় দিতে পারবেন না? অপর্ণা সেেনর মতে বন্ধুদের ব্যাপারে জাজমেন্টাল হলে চলে না। আপনি কত বার ফোন করেছেন, বন্ধু কত বার নেমন্তন্ন করেছেন, এ সবের মধ্যে আটকে থাকবেন, নাকি এই অনবদ্য সম্পর্কটিকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন? তাই বোধ হয়, অপর্ণা সেনের মতো এক ভাল বন্ধু অনায়াসে বলতে পারেন, “বন্ধুদের সঙ্গে সব সময় জুড়ে থাকার চেষ্টা করি। খুব বিশ্বস্ত বন্ধু আমি।’’
একই ইন্ডাস্ট্রির সতীর্থ সুজিত এবং শান্তনু। কলেজে পড়েছেন একসঙ্গে। মুম্বইতে লড়াই করে সাফল্যও পেয়েছেন একসঙ্গে। আজও প্রতি সপ্তাহে দেখা করেন দুজনে। ফুটবল খেলেন, গল্প করেন। ওঁদের মতে বন্ধুত্বের মেসেজ ‘সেন্ড’ করা যায় না। তাই বন্ধুর জন্য সময় বের করেন। ঠিক সে কারণেই দেশের অন্য প্রান্তে ছুটে যেতেও আপত্তি নেই অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের। ওঁর কথায়, “ফেসবুক, টুইটার কেজো। কিন্তু বন্ধুত্ব তো কাজ নয়। অন্তরের আরাম।’’
তাই এক পা বাড়িয়েই দেখুন না। বন্ধু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবেন আপনাকে। করুন না নিজে থেকে ফোন। আপনার আত্মসম্মান খোয়া যাবে না। তার পর বন্ধুর সঙ্গে বসে গানের ওই শেষ দু’টো লাইন আর একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন কি না দেখুন না। ..‘বন্ধু চল’ গানের শেষ লাইনে আছে ‘.তোর টিমে, তোর পাশে.... থেকে, বন্ধুর নাগপাশে, পেলব হাতযশে...।’ দোহাই, আপনার বন্ধুত্বের কবিতার মাঝে আব্বুলিস বলবেন না।