টেস্টোস্টেরন হরমোন থেরাপি কী, খরচ কত হবে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভালবাসার যদি কোনও বয়স না থাকে, তা হলে বিয়েরই বা হবে কেন! দু’টো মানুষের একসঙ্গে পথ চলার শুরু যে কোনও বয়সেই হতে পারে। একসঙ্গে থাকা বা সংসার সাজানোর বয়স যে তথাকথিত লক্ষণরেখাটি পেরিয়ে গিয়েছে, তা তো সাম্প্রতিক সময়ের কয়েক জন তারকার বিয়ের উদাহরণেই স্পষ্ট। ৬১ বছরে পৌঁছে ঘর বেঁধেছেন রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ৫১-তে পৌঁছে বিয়ে করলেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। পাত্র পিনাকী মিশ্রের বয়স ষাট পেরিয়েছে। বলিউডে মিলিন্দ সোমন ৫৩ বছরে গাঁটছড়া বেঁধেছেন ২৬ বছরের অঙ্কিতা কোনারের সঙ্গে। আছেন আরও অনেকেই। আশিস বিদ্যার্থী, দীপঙ্কর দে মতো উদাহরণ তো ভূরি ভূরি।
কিন্তু এখনও একটি বয়সের পরে বিয়ে করলে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অনেকের মনে। একটু বেশি বয়সে বিয়ে এবং সঙ্গিনীকে পাশে নিয়ে চলার ক্ষেত্রে ভালবাসা বাধা না হলেও, সুখের পথে শরীর কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। কারণ, একটি বয়সের পরে পুরুষের শরীরে হরমোনের খেলাই বদলে যায়। শরীরের শক্তি কমে। সেই সমস্যারই সমাধান করতে পারে টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি। এর কাজ অনেক। শুক্রাণুর সংখ্যা বাড়িয়ে তা যেমন প্রজননে সাহায্য করতে পারে, তেমনই বন্ধ্যত্বের সমস্যারও সমাধান করতে পারে। নানা অসুখবিসুখে ভুগে বয়সকালে হোক বা কম বয়সে, যে পুরুষের শরীরে হরমোনের গোলমাল দেখা দিয়েছে, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁর শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সমাধান হতে পারে টেস্টোস্টেরন হরমোন থেরাপিতে। এই থেরাপি করালে পেশির শক্তি বাড়ে। শরীরে বল ফিরে আসে।
টেস্টোস্টেরন হরমোন থেরাপিতে শরীরের শক্তি বাড়ে। ছবি: সংগৃহীত।
টেস্টোস্টেরন হরমোন থেরাপি নিয়ে এ শহরেও চিন্তাভাবনা হচ্ছে। তার কিছু কারণও আছে। এ শহরেও বয়স্কদের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সংবাদপত্র, ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে বয়স্ক পাত্র-পাত্রীর ছড়াছড়ি। ফেসবুকে তৈরি হচ্ছে আলাদা কমিউনিটি। ভাবনা পরিণত হয়েছে, শহর পরিণত হচ্ছে, চারপাশের কটাক্ষকে দুয়ো দিয়ে একটু ভাল থাকার চেষ্টা হচ্ছে সে ঠিকই, তবে তাই বলে শরীর তো আর বদলাবে না। মনের বয়স ত্রিশে নামিয়ে আনলেও, শরীরের বয়স কমানোর জাদুকাঠি এখনও হাতে আসেনি। শরীর বুড়ো হোক ক্ষতি নেই, যৌবনের মতো শক্তিটুকু ধরে রাখতে আপত্তি কোথায়। ‘টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’ সে অসাধ্য সাধনই করছে।
পৌরুষ ধরে রাখার চিকিৎসা
মেয়েদের যেমন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন যৌনইচ্ছা, সন্তানধারণ থেকে শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামলায়, ছেলেদের তেমনই জিয়নকাঠি হল টেস্টোস্টেরন হরমোন। শুক্রাণু তৈরি, পুরুষালি শরীরের গঠন সবের পিছনেই কলকাঠি নাড়ে এই হরমোনটিই। পুরুষের শরীরে সেই হল হোমড়াচোমড়া হরমোন। নেতা গোছের এই হরমোনটি কমে গেলে, পুরুষের শক্তিই টালমাটাল হতে থাকে। শরীরের শক্তি যেমন কমে যায়, তেমনই প্রজননের পথটিও জটিল হয়ে ওঠে। বাবা হওয়ার ক্ষমতা আর তেমন ভাবে থাকে না। কিন্তু বললেই তো আর হরমোনটিকে ধরেবেঁধে রাখা যাবে না, বয়স হলে সে আপনা থেকেই কমতে থাকবে। আবার কোনও রকম শারীরিক সমস্যা হলে বা অস্ত্রোপচার হলে, দুর্ঘটনা ঘটলে তখনও হরমোনটির ক্ষরণে গোলমাল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই টেস্টোস্টেরন হরমোনটিকে চাঙ্গা রাখতে পারলেই, পুরুষের যৌবন ষাটেও অক্ষুন্ন থাকবে। সে কাজটিই করবে ‘টেস্টোস্টের রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’ (টিআরটি)।
পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের গুরুত্ব অনেক। ছবি: ফ্রিপিক।
সূচ ফুটিয়ে হোক, খাওয়ার ওষুধ দিয়ে অথবা জেল লাগিয়ে বা শরীরে প্যাচ সেঁটে দিয়ে, হরমোনটি শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়াই কাজ। তাতে সময়ও কম লাগবে এবং খরচও কম হবে। যদি ঠিকঠাক এই পদ্ধতি কাজ করে, তা হলে ষাটে পৌঁছেও যৌবনের মতো শক্তি পাওয়া যেতে পারে।
হরমোন থেরাপি কাদের জন্য?
টেস্টোস্টেরন হরমোন অনেক মহিলাও নেন। বিশেষ করে শরীরের শক্তি বাড়াতে অ্যাথলিটরা এমন হরমোনের থেরাপি করে থাকেন বলে জানালেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। তবে তার নির্ধারিত ডোজ় আছে। ডোপ পরীক্ষায় সময়ে প্রস্রাবে এই হরমোনটি কতটা আছে, সেটিই দেখা হয়। আসলে টেস্টোস্টেরন হরমোন থেরাপির মূল কাজই হল শক্তি বৃদ্ধি করা। হরমোনটি যদি সূচ ফুটিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে পেশির শক্তি বাড়বে, অন্য হরমোনগুলিও দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করা শুরু করবে।
থেরাপিটি দু’রকম কাজের জন্য করা হয়— ১) বন্ধ্যত্বের সমস্যা থাকলে। অনেক সময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষমতাও বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। চিকিৎসকের পরিভাষায় একে বলে ‘সেক্সুয়াল ডিসফাংশন’। এ ছাড়া থাকতে পারে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন, অর্থাৎ এতে পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হওয়ার সমস্যা ও ইজ্যাকুলেশনের সমস্যাও থাকতে পারে।
টেস্টোস্টেরন থেরাপির কাজ অনেক, কারা করাতে পারেন? ছবি: ফ্রিপিক।
২) একটু বেশি বয়সে পৌঁছে যদি কেউ যৌবনের মতো যৌনক্ষমতা ধরে রাখতে চান, সে ক্ষেত্রেও এই থেরাপিটি করা হয়ে থাকে।
যৌন ক্ষমতা বাড়ানোই এই থেরাপির একমাত্র লক্ষ্য, তা কিন্তু নয়। এর কাজ আরও অনেক। সংক্রমণ, হরমোন ও জিনগত সমস্যা, পরিবেশ ও জীবনশৈলীর কারণে পুরুষের বন্ধ্যত্ব দেখা যায়। মূলত মাম্পস বা ওই জাতীয় সংক্রামক জ্বরের ফলে যদি শুক্রাশয় ফুলে যায় সেখান থেকে শুক্রাণুর ক্ষতি হয়। এ ছাড়া, ডায়াবিটিস, ক্যানসার ইত্যাদি কারণেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শুক্রাণু নষ্ট হতে থাকে। তখন এই থেরাপিটি ভরসার হাত হতে পারে।
জন্মগত ভাবে শুক্রাশয়ের গঠনে ত্রুটি থাকে অনেকের। অনেকেরই শুক্রাশয়ের গঠন ঠিক হয় না। তলপেট থেকে নীচের দিকে পুরোপুরি ভাবে গঠিত হয় না সেটি। এটিকে বলা হয় ‘আনডিসেন্ডেড টেস্টিকুলার’। পরে সেই শুক্রাশয় থেকে ক্যানসার ও বন্ধ্যত্ব সংক্রান্ত নানা সমস্যা আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে থেরাপিটি করান অনেকে।
শরীরচর্চার জন্য বেশি মাত্রায় স্টেরয়েড ব্যবহার করলে, অতিরিক্ত অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ও অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ খেলেও বন্ধ্যত্বের সমস্যা আসে। সে ক্ষেত্রেও শুক্রাণু উৎপাদন কমে যায়। এখনকার সময়ে এই ধরনের স্টেরয়েড নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে কমবয়সিদেরও। যে কারণে অল্প বয়স থেকেই যৌন অক্ষমতার সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ওষুধ খাওয়ানো হয় না ইঞ্জেকশন?
থেরাপিটি চার রকম ভাবে হয়, খাওয়ার ওষুধ, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে থেরাপি, জেল থেরাপি এবং প্যাচ। ইউরোলজিস্ট কৌশিকচন্দ্র মল্লিক জানান, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে থেরাপিটি করলে ২ বা ৩ সপ্তাহ অন্তর সূচ ফোটানো হয়। ট্রান্সডার্মাল প্যাচ দিয়েও থেরাপিটি করা হয়।
ইঞ্জেকশন, জেল, প্যাচ— নানা ভাবে চিকিৎসাটি করা হয়। ছবি: ফ্রিপিক।
খরচও খুব বেশি নয়। কোন ব্র্যান্ডের ওষুধ বা জেল ব্যবহার করা হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে। ইঞ্জেকশন থেরাপি হলে খরচ ৫০০ থেকে ২ হাজারের মধ্যে বা তারও কমে হয়ে যায়। জেল থেরাপির খরচ মাসে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে আর প্যাচ থেরাপির ক্ষেত্রে খরচ হতে পারে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা।
‘মেনোপজ়’ যখন পুরুষ শরীরে
জীবনের একটি পর্যায়ে গিয়ে ‘মেনোপজ়’ পুরুষেরও হয়। অনেকেই শুনলে চমকে উঠবেন। রজোনিবৃত্তির মধ্যে দিয়ে মহিলাদের যেতে হয়, এটাই বাস্তব। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এই পর্বটি আসে পুরুষের জীবনেও। তার নাম অ্যান্ড্রোপজ়। একে হাইপোগোনাডিজ়মও বলা হয়। অর্থাৎ, টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা যখন একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এর লক্ষণগুলি এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হতে পারে। কারও যৌনক্রিয়ার ইচ্ছা কমে যায়, কেউ ভোগেন অত্যন্ত মানসিক চাপ ও অবসাদে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। হতে পারে মুড সুইং-ও। টেস্টোস্টেরন হরমোন যে হেতু পেশির গঠনেও ভূমিকা নেয়, তাই সেটি কমে যাওয়া মানেই পেশি শিথিল হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মেদ বাড়তে পারে, স্তনের আকার বাড়তে পারে, হার্টের পেশিও এর কারণে প্রভাবিত হওয়ায় দেখা দেয় হার্টের সমস্যা। এই সব লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। তিনি প্রয়োজন মনে করলে, টেস্টোস্টেরন হরমোন থেরাপি করানোর পরামর্শ দেবেন।
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা।
মন্দ দিকও কম নয়
টেস্টোস্টেরন থেরাপির কথা শুনে যতই নিশ্চিন্ত মনে হোক না কেন, এর মন্দ দিকগুলি এড়িয়ে গেলে চলবে না। কোনও কিছুরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। সূচ ফোটালেই যে বার্ধক্যে যৌবনের তেজ ফিরে আসবে, তা সকলের ক্ষেত্রে না-ও হতে পারে। যদি সব জেনেশুনে, চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে নিজে থেকে টেস্টোস্টেরন ইঞ্জেকশন নিতে শুরু করেন, তা হলে বিপদ ঘনাতে দেরি হবে না। হার্টের রোগ থাকলে এই থেরাপি না করারই পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
রক্তের ঘনত্ব আচমকা বাড়িয়ে দিতে পারে এই থেরাপি। প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন টানা নিতে থাকলে ত্বকে ব্রণ, ফুস্কুড়ি দেখা দেবে, রাতে ঘুমের সমস্যা হবে, রক্তচাপের ওঠানামা চলতেই থাকবে। ঘন ঘন বদলে যাবে মেজাজ। শরীরের অন্যান্য হরমোনগুলির ক্ষরণ তালগোল পাকিয়ে যাবে। শেষে একটা সময়ে গিয়ে এই থেরাপি আর কাজই করবে না। বয়স ৬০ বা ৭০ পেরিয়ে গিয়েছে যাঁদের, তাঁরা থেরাপিটি করানোর আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। যদি অন্য অসুখবিসুখ খুব বেশি থাকে, তা হলে এই চিকিৎসার পথে না যাওয়াই মঙ্গলের। বৃদ্ধ বয়সে এত হরমোনের ধকল শরীর সইতে পারবে না।