Y chromosome is Disappearing

পিতার থেকে আসা ‘ওয়াই ক্রোমোজ়োম’ নাকি বিলুপ্তির পথে! বিবর্তনের গেরোয় হারিয়ে যাবেন কি পুরুষেরা?

বাবা দিচ্ছেন ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োম আর মা দিচ্ছেন ‘এক্স’। দুইয়ে মিলে তৈরি হচ্ছে পুরুষ শরীর। কোটি কোটি বছর ধরে একটু একটু করে বিলুপ্তির পথে হাঁটছে ‘ওয়াই ক্রোমোজ়োম’। এর পরে তবে কী হবে?

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ ০৯:০০
Share:

বিপদে ‘ওয়াই’, পুরুষেরা কি তবে হারিয়ে যাবেন?

বিশ্বটা কি কেবল নারীদের হয়ে যাবে? চারপাশে পুরুষেরা কি থাকবেন না? ‘ওয়াই ক্রোমোজ়োম’ নাকি বিলুপ্ত হতে চলেছে! নানা মহলে এই নিয়ে চর্চা চলছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা সত্যি। যে ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োম পুরুষদের পুরুষ বানায়, সেটি ধীরে ধীরে গায়েব যাচ্ছে। কোটি কোটি বছর ধরে একটু একটু করে বিলুপ্তির পথে হাঁটছে ‘ওয়াই ক্রোমোজ়োম’। আরও কয়েক লক্ষ বছর পরে, তা পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা। এর পরে তবে কী হবে?

Advertisement

না, এত চিন্তার কারণ নেই। ‘ওয়াই ক্রোমোজ়োম’ বিলুপ্ত হলেও পুরুষেরা বিলুপ্ত হচ্ছেন না। আসলে একটি ক্রোমোজ়োম তৈরি হয় অসংখ্য জিন দিয়ে। ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমও তেমন ভাবেই তৈরি হয়েছে। তারই কয়েকটি জিন বিলুপ্ত হচ্ছে। ফলে তার জায়গায় আসছে নতুন জিন। নতুন রূপ ধারণ করে তৈরি হচ্ছে ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমের বিবর্তিত একটি প্রতিরূপ।

বিপদে 'ওয়াই'। ছবি: শাটারস্টক।

‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’ জার্নালে বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। ‘নেচার’ পত্রিকাতেও লিখেছেন বহু বিজ্ঞানী। ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে গবেষণার সত্যতা যাচাইয়ের কাজও চলছে। জাপানের এক প্রকার মেঠো ইঁদুরের ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমটি নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। তবে এর পরেও পুরুষ ইঁদুরেরা দিব্যি বেঁচেবর্তে রয়েছে। আর সেখানেই রয়েছে আসল চমক।

Advertisement

জিনতত্ত্ব বড়ই জটিল

ক্রোমোজ়োমই সর্বেসর্বা। আসল কলকাঠি সে-ই নাড়ে। মায়ের থেকে সবসময়ে আসে ‘এক্স’ আর বাবার থেকে কখনও ‘এক্স’ আবার কখনও ‘ওয়াই’। (কারণ ওয়াই শুধু পুরুষ শরীরেরই থাকে)। মা এবং বাবা দু’জনের থেকে যদি দু’টি এক্স ক্রোমোজ়োমই যায়, তা হলে কন্যাসন্তান হয়। আর মায়ের এক্সের সঙ্গে যদি মেলে বাবার ওয়াই, তবে পুত্রলাভ ঘটে।

অতএব লিঙ্গ নির্ধারণের কাজটি করে ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োম। আরও একটু বিশদে বললে, এই ওয়াই ক্রোমোজ়োমে থাকা একটি জিন, যার নাম ‘এসআরওয়াই’। এই জিন থেকে তৈরি হওয়া প্রোটিনই ঠিক করে দেয় মাতৃজঠরে থাকা ভ্রূণের যৌনাঙ্গ পুরুষের মতো হবে, না কি নারীর মতো। অর্থাৎ, টেস্টোস্টেরন বেশি তৈরি হবে, না ইস্ট্রোজেন। বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। অতটা সরলও নয়। ওই দুই হরমোন আবার ঠিক করে দেয় ভ্রূণের মস্তিষ্ক গঠন পুরুষের মতো হবে, না কি নারীর মতো। তা হলে প্রশ্ন আসবে, পুরুষ ও নারীর মস্তিষ্ক কি তবে আলাদা?

মায়ের থেকে এক্স আর বাবার থেকে ওয়াই এসে তৈরি হয় পুরুষ শরীর। ছবি: ফ্রিপিক।

তা কিন্তু নয়। মস্তিষ্কে থাকা বিশেষ কিছু গ্রাহক প্রোটিন আলাদা। যেগুলি পুরুষ বা নারীর ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ভাবে সক্রিয়তা দেখায়। এখন যদি হঠাৎ শোনা যায় ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমটাই থাকবে না, তা হলে তো শিরে সংক্রান্তি। গোটা প্রক্রিয়াটিই ওলটপালট হয়ে যাবে। জট পাকিয়ে যাবে জিনের গঠন। তালগোল পাকাবে হরমোনেরা।

কেন বিপদে ‘ওয়াই’?

২৩ জোড়া ক্রোমোজ়োম দিয়ে শরীর তৈরি হয়। তার মধ্যে ২২ জোড়া অটোজ়োম আর এক জোড়া ‘সেক্স’ ক্রোমোজ়োম অর্থাৎ, এক্স এবং ওয়াই। এরা আবার অসংখ্য জিন নিয়ে তৈরি। এই জিনগুলি নিজেদের মতো করে সেজেগুজে পর পর জুড়ে থাকে। এই শৃঙ্খলের কোনও একটি বা দু’টি জিন যদি হারিয়ে যায় বা ক্ষতবিক্ষত হয়, তা হলে গোটা শৃঙ্খলটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। তেমনই ঘটছে ওয়াই ক্রোমোজ়োমের ক্ষেত্রে।

লিঙ্গ নির্ধারণের কাজটি করে 'সেক্স ক্রোমোজ়োম'। ছবি: সংগৃহীত।

গবেষকেরা দাবি করেছেন, এই জিনগুলিই বিলুপ্ত হচ্ছে। ‘এক্স’ ক্রোমোজ়োমের ৯০০টি জিন একই রকম আছে, তাদের মধ্যে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমে এখন মাত্র ৫৫টি জিন টিকে আছে। গত ৩০ কোটি বছর ধরে ধীরে ধীরে বাকি সব জিন বিলুপ্ত হয়েছে। আরও প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ বছর পরে ওই ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’-র মতো পড়ে থাকা ৫৫টি জিনও নাকি হারিয়ে যাবে। তা কী ভাবে হবে, সে নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীরা বেশি কিছু বলতে পারেননি।

‘অস্ট্রেলিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’-এর জিনতত্ত্ববিদ জেনিফার এ মার্শাল গ্রেভস ওয়াই ক্রোমোজ়োম নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই গবেষণা করছেন। তাঁর দাবি, ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমে একটা সময়ে ১৪৩৮ সংখ্যক জিন ছিল। গত ৩০ কোটি বছর ধরে ১৩৯৩ সংখ্যক জিন ক্ষয়ে গিয়ে, গুটিকয়েকই পড়ে রয়েছে। যার মধ্যে মুখ্য যে জিন অর্থাৎ ‘এসআরওয়াই’, যেটি পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণ করে, সেটিই ক্ষয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

জিনে-জিনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই

লড়াই চলছে। কেউ হারছে, তো কেউ জিতছে। বিবর্তনের ধারা বড়ই রহস্যময়। কিন্তু শেষমেশ সব যুদ্ধেই সে জয়ী। নিজের জায়গায় অবিচল। মানুষের দেহের প্রতিটি কোষে প্রতিনিয়ত জিন বা ডিএনএ-র এই যুদ্ধজয়ের কাহিনি রোমাঞ্চ জাগাবেই। এখানেই হল ‘টুইস্ট’। বিবর্তনের পথে জিনও তার বিকল্প খুঁজে নিয়েছে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমের ‘এসআরওয়াই’ জিন বিলুপ্ত হতে চলেছে ঠিকই, তবে তার জায়গায় ‘এসওএক্স৯’ নামক আরও একটি জিন সক্রিয় হয়ে উঠছে। এই জিনটি মহিলাদের থাকে না। শুধুই পুরুষের।

ছবি: ফ্রিপিক।

জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখেছেন, তিন নম্বর ক্রোমোজ়োমের কাছে রয়েছে ওই জিন। সেটিতে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, আগামী দিনে সেটিই ‘এসআরওয়াই’-এর জায়গা নেবে ও পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করবে। কাজেই ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োম চিরতরে হারিয়ে যাবে, এমনটা হয়তো কখনওই হবে না।

কল্যাণীর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জিনোমিকস’-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক পার্থপ্রতিম মজুমদার ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমের এই অবক্ষয়ের কথা মানতে রাজি নন। তিনি জানান, বিশেষ কিছু অসুখে ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমের ক্ষয় হয়। এমনিও ক্রোমোজ়োমের ক্ষয় নতুন কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োম হারিয়ে যাবে, এটা এখনই বলা যায় না। সবটাই বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ও অনুমান মাত্র। এই বিষয়ে আরও বিশদ গবেষণা প্রয়োজন।

সিঁদুরে মেঘ দেখেছেন চিকিৎসকেরাও

‘সেক্স’ ক্রোমোজ়োম অর্থাৎ এক্স এবং ওয়াই কেবল লিঙ্গ নির্ধারণ করে তা-ই নয়, পুরুষ ও নারীর উর্বরতা বা সন্তানধারণের ক্ষমতাও সেখানে জড়িত। ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োমের যে ক্ষয় হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার অনেকটাই দেখা গিয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানেও। এমনটাই জানিয়েছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। শুক্রাণুর মান ও সংখ্যা কমছে। বাড়ছে পুরুষ বন্ধ্যত্ব। যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় ‘ওয়াই ক্রোমোজ়োম মাইক্রোডিলিশন’। অর্থাৎ, শুক্রাণুর উৎপাদন, ঘনত্ব, গুণগত মান, সবই কমছে। এর নেপথ্যে যেমন বংশগত কারণ রয়েছে, তেমনই রয়েছে জীবনযাপনে অসংযম, পারিপার্শ্বিক ও প্রকৃতিগত বিষয়ও।

আরও একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, যা হল ‘জেনেটিক মিউটেশন’ (জিনের রাসায়নিক বদল)। সেটি বাবা-মায়ের থেকে আসে না। বরং প্রতিটি জিনে বদল আসে নানা কারণে। একে বলে ‘ডি নোভো ক্রোমোজ়োম’। যদি ওয়াই ক্রোমোজ়োম ভেঙে যায়, ক্ষতবিক্ষত হয় অথবা তাতে বদল আসে, তা হলে নানা রকম জিনগত রোগ দেখা দিতে থাকে। যেমন, ডাউন সিনড্রোম যেখানে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২১তম ক্রোমোজমে দু’টির বদলে তিনটি ক্রোমোজোম থাকে। আবার ক্লাইনফিল্টার সিনড্রোম যেখানে পুরুষের দু’টির বদলে তিনটি ক্রোমোজ়োম থাকে— দু’টি এক্স ও একটি ওয়াই ক্রোমোজ়োম।

বিবর্তনের ধারায় বার বার বদল ঘটেছে, তবু নুয়ে পড়েনি। ছবি: ফ্রিপিক।

জিনের যাত্রাপথে কিছু ভুলত্রুটি হতেই পারে, তবে তা বড় বিপর্যয় ঘটাবে না বলেই মত অনেক বিজ্ঞানীর। রোজ রোজ হাজার হাজার স্বতঃস্ফূর্ত বদল ঘটছে জিনের অন্দরমহলে। কোষ বিভাজনের সময় তার প্রতিলিপি তৈরি হতে গিয়েও অসংখ্য বার আক্রান্ত হচ্ছে ডিএনএ। তবে এর পরেও সে নুয়ে পড়েনি। জখম সারিয়ে নতুন করে পথ চলার উপায় খুঁজে নিয়েছে। আগামী দিনেও এর অন্যথা হবে না বলেই আশায় বুক বেঁধেছেন বিজ্ঞানীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement