মদ্যপানের পরে আতঙ্ক, কী এই রোগ, কারা ভোগেন? ফাইল চিত্র।
মদ্যপানের নেশা মজ্জায় মজ্জায় চেপে বসেছিল। তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কতটা জটিল ছিল, তা নিয়ে মুখ খুললেন বলিউড অভিনেতা রণিত রায়। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রণিত জানিয়েছেন, মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অ্যালকোহল ছাড়া এক দিনও থাকতে পারতেন না। আর তাতেই নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে থাকে তাঁর। মদ্যপানের পরেই আতঙ্ক শুরু হত, স্ত্রী ও সন্তানের সামনে অনুশোচনাতেও ভুগতেন। ঠিক কী সমস্যা হত রণিতের?
৫৯ বছরের রণিতকে স্বাস্থ্য সচেতন বলেই জানেন সকলে। নিয়মিত শরীরচর্চা করেন তিনি, থাকেন কড়া ডায়েটে। মাঝেমধ্যেই নিজের কার্ডিয়ো সেশনের ছবি পোস্ট করেন সমাজমাধ্যমে। কিন্তু একটা সময়ে জীবনযাপনে এত সংযম ছিল না তাঁর। রণিত জানিয়েছেন, রোজ মদ্যপান করে বাড়ি ফিরতেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়ে একরাশ ক্লান্তি চেপে ধরত তাঁকে। কাজে যাওয়ার উৎসাহ থাকত না। দিনভর ঝিমুনি, মাথা ব্যথা কাহিল করত। সেই সঙ্গেই ঘন ঘন বদলে যেত মনমেজাজ। আচার-আচরণ, ব্যবহারেও বদল আসতে শুরু করে। অথচ আসক্তি এতটাই ছিল যে, মদ্যপানের নেশা কাটিয়ে উঠতেও পারতেন না। পরবর্তী সময়ে তাঁর এই আসক্তি নিয়ে পরিবারেও অশান্তি হতে শুরু করে। ফলে অজানা এক আতঙ্ক শুরু হয় তাঁর মনে।
মদ্যপানের পরে বিভ্রান্তি, অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ, মনের মধ্যে অজানা ভয়-উদ্বেগ হলে তা মোটেই সামান্য ব্যাপার নয়, এমনটাই বলছেন দেশের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন অ্যালকোহল অ্যাবিউজ় অ্যান্ড অ্যালকোহলিজ়ম’-এর গবেষকেরা। মদ্যপানের আসক্তি কাটিয়ে উঠতে পারেন না, আবার এই নেশা নিয়ে আতঙ্কেও ভোগেন অনেকে। এই সমস্যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যালকোহল ইউজ় ডিজ়অর্ডার’ (এইউডি)। এই সমস্যা যতটা শারীরিক, তার চেয়েও বেশি মানসিক। ভারতে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশের বেশি মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন, অর্থাৎ প্রতি ১২ জন ভারতীয়ের অন্তত এক জনের এইউডি আছে।
অ্যালকোহল ইউজ় ডিজ়অর্ডার আপনার নেই তো?
এমন কিছু লক্ষণ আছে, যা থেকে বোঝা যেতে পারে যে, মদ্যপান কেবলই নেশা, না কি ডিজ়অর্ডারের চেহারা নিচ্ছে। কী কী লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে?
১) দিনের বেশির ভাগ সময়েই মদ্যপান করার ইচ্ছা জাগবে, চাইলেও নিজেকে সামলানো যাবে না।
২) যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই থাকুক না কেন, সব ছেড়ে মদ্যপানই করতে থাকবেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
৩) এক দিনের জন্য অ্যালকোহল না পেলে শরীরে অস্বস্তি হবে, খিঁচুনি হতে পারে, দরদর করে ঘাম হবে। পাশাপাশি, মেজাজ বিগড়ে যাবে। আচরণেও বদল আসবে।
৪) মদ্যপান করার পরে শরীর ও মনের ক্ষতি হচ্ছে বুঝেও আসক্তি কাটাতে পারবেন না।
৫) মদ্যপানের পরেই মনে অজানা আতঙ্ক শুরু হবে, গ্লানিবোধ হতে থাকবে। দুশ্চিন্তা বেড়ে যাবে। পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে।
আসক্তি কাটাবেন কী ভাবে?
মদ্যপানে আসক্তি এক দিনে কাটানো সম্ভব নয়। দীর্ঘ দিন ধরে কিছু সংযম অভ্যাস করতে হয়। এই নিয়ে ‘হার্ভার্ড হেল্থ’-থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র আছে। সেই গবেষণাপত্র অনুযায়ী জানা যাচ্ছে—
১) দিনের যে সময়টাতে মদ্যপানের আসক্তি বাড়ে, সেই সময়ে অন্য কোনও কাজ রাখুন অথবা ডিটক্স পানীয় খাওয়ার চেষ্টা করুন।
২) প্রথমেই পরিমাণ কমানোর চেষ্টা না করে, একেবারে মদ্যপান না করে কাটানোর চেষ্টা করুন কয়েকটি দিন। প্রথমে কষ্ট হবে, কিন্তু তার পর সামলেও নিতে পারবেন।
৩) কোন দিনগুলিতে মদ্যপান করছেন না, সে দিনগুলি কী ভাবে কাটালেন, তা ডায়েরিতে লিখে রাখুন। শরীরে কী কী বদল আসছে, তা-ও লিখে রাখার চেষ্টা করুন।
৪) নেশা চাগাড় দিলেই শরীরচর্চা করার চেষ্টা করুন। বাইরে বেরিয়ে হাঁটা অথবা জিমে গিয়ে ওয়েট ট্রেনিং, কার্ডিয়ো করলে মন অন্য দিকে থাকবে।
৫) মদ্যপান যে দিন করছেন না, সে দিন কতটা ভাল থাকছেন, সেটাই বার বার মনে করতে হবে। মদ্যপান ছাড়লে কী কী লাভ হবে, সেই লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। একান্তই সম্ভব না হলে ‘মোটিভেশনাল এনহান্সমেন্ট থেরাপি’ (এমইটি) করিয়ে দেখতে পারেন।
৬) কোনও কিছুতেই নেশা কাটিয়ে উঠতে না পারলে, চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। সে ক্ষেত্রে নানা রকম কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ‘কগনিটিভ বিহেভিয়োরাল থেরাপি’ (সিবিটি) করান চিকিৎসকেরা।