ফের বেলাইন ট্রেন, বিপাকে কেন্দ্র

পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দু’টো রেল দুর্ঘটনা। প্রথমটায় মৃত্যু হয়েছিল অন্তত দেড়শো জনের। আর আজকের দুর্ঘটনা কারও প্রাণ না নিলেও রেখে গিয়েছে একরাশ অস্বস্তি। নরেন্দ্র মোদীর জন্য। তাঁর দল ও সরকারের জন্য। তাঁর রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর জন্য। কারণ, গত মাসে ইনদওর-পটনা এক্সপ্রেস এবং আজ শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেস— দু’টো ট্রেনই লাইনচ্যুত হয়েছে উত্তরপ্রদেশে।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৮
Share:

দুর্ঘটনাগ্রস্ত শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেসের কামরা। বুধবার কানপুরের কাছে রুরায়। আহত হয়েছেন ৬২ জন যাত্রী। ছবি: এএফপি।

পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দু’টো রেল দুর্ঘটনা। প্রথমটায় মৃত্যু হয়েছিল অন্তত দেড়শো জনের। আর আজকের দুর্ঘটনা কারও প্রাণ না নিলেও রেখে গিয়েছে একরাশ অস্বস্তি।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদীর জন্য। তাঁর দল ও সরকারের জন্য। তাঁর রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর জন্য। কারণ, গত মাসে ইনদওর-পটনা এক্সপ্রেস এবং আজ শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেস— দু’টো ট্রেনই লাইনচ্যুত হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। সেই রাজ্যে ভোট আসন্ন। নিয়ন্ত্রণরেখায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, নোট বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত ‘ব্যুমেরাং’ হওয়ার পাশাপাশি একের পর এক রেল দুর্ঘটনাও মোদীর উত্তরপ্রদেশ জয়ের স্বপ্নে জল ঢালতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। বিরক্ত হয়ে কেউ কেউ বলেই ফেলছেন, ‘‘টুইটারে যাত্রী-পরিবেষার চটক দিয়ে বাজিমাতের চেষ্টা না করে প্রভু যদি রেলের সুরক্ষা ও পরিকাঠামোর দিকে বেশি নজর দিতেন, তা হলে কাজের কাজ হতো।’’ রেলকর্তারাও হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখছেন, পরিস্থিতি না শুধরোলে আরও বাড়বে দুর্ঘটনা।

আজ ভোরে কানপুরের কাছে রুরায় লাইনচ্যুত হল শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেস। কেউ মারা না গেলেও আহত হয়েছেন ৬২ জন যাত্রী। প্রাথমিক ভাবে দুর্ঘটনার পিছনে লাইনে ত্রুটির কথা মনে হলেও ঘটনার কারণ জানতে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রেলওয়ে সেফটি কমিশনার (উত্তর) এস কে পাঠককে।

Advertisement

অথচ নোট বাতিলের ধাক্কা সামলে ভোটমুখী উত্তরপ্রদেশকে কার্যত একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মোদী। আগামী ২ জানুয়ারি লখনউয়ে কৃষি ঋণ মকুব ছাড়াও একাধিক প্রকল্প ঘোষণার কথা রয়েছে তাঁর। সলতে পাকাতে আজকের ২৮ তারিখটি মাথায় রেখে এ দিন গুনে গুনে ২৮টি রেল প্রকল্প ঘোষণার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ঠিক ছিল, দিল্লির রেল ভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্পগুলির উদ্বোধন করবেন সুরেশ প্রভু-উমা ভারতীর মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। আর উত্তরপ্রদেশে শিলান্যাস-মঞ্চে থাকবেন দলীয় সাংসদেরা। কিন্তু আজ ভোর সাড়ে পাঁচটার দুর্ঘটনা ভেস্তে দেয় সব পরিকল্পনা। কোনও যাত্রীর মৃত্যু না হলেও মান বাঁচেনি প্রভুর।

অথচ বাজপেয়ী জমানায় এই প্রভুর হাত ধরেই আমূল সংস্কার হয়েছিল বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে। সেই প্রভুই এখনও পর্যন্ত রেলে কার্যত ব্যর্থ বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ। দলীয় সূত্রও বলছে, দ্রুত রেলমন্ত্রীর উপরে আস্থা হারাচ্ছেন মোদী। কারণ রেলের সংস্কার সাধন করে আয় বাড়িয়ে নতুন চেহারা দেওয়া তো দূর, উল্টে প্রভুর জমানায় লাফিয়ে বেড়েছে দুর্ঘটনার সংখ্যা। বিশেষতগত এক বছরে। যা আখেরে বিপাকে ফেলছে মোদীকেই।

একই সঙ্গে, রেল বাজেট অর্থ মন্ত্রকের হাতে তুলে দেওয়ার মতো নানা কারণে নিজের মন্ত্রকেও জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেছেন রেলমন্ত্রী। মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, আর্থিক টানাটানির যুক্তি দেখিয়ে গত আড়াই বছরে রেলের স্বাস্থ্য ফেরাতে প্রভু কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঝুঁকি নেননি। উপেক্ষা করেছেন পরিকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিকীকরণের মতো ক্ষেত্রগুলি। কেবল জোর দেওয়া হয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রে। ফলে চলন্ত ট্রেনে মোবাইল থেকে হেল্পলাইন নম্বর ডায়াল-করা যাত্রীর হাতে খাবারের প্যাকেট পৌঁছেছে ঠিকই, কিন্তু উপেক্ষিত থেকেছে লাইন পাল্টানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিংবা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ।

মন্ত্রক সূত্রের খবর, এ বছরের ৮৮টি রেল দুর্ঘটনার মধ্যে লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ৬৮টি। মারা গিয়েছেন অন্তত ২১৫ জন যাত্রী। তদন্তে দেখা গিয়েছে, লাইনের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই দুর্ঘটনাগুলির কারণ (যার মধ্যে আজকের দুর্ঘটনাটিও পড়ে)। রেলকর্তারা গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আজকের দুর্ঘটনাস্থলটি দেখে। কারণ সেটি ঘটেছে গ্র্যান্ড কর্ড (কানপুর-টুন্ডলা-আগরা) লাইনে। ভারতীয় রেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লাইন হল এই সেকশনটি। রেলকর্তাদের বক্তব্য, পূর্ব ভারতগামী রাজধানী, দুরন্তের মতো ট্রেনগুলি এই লাইনেই ছোটে। এই লাইনের সর্ব্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। ওই গতিবেগে থাকা কোনও ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়লে কী বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হতো, ভেবেই আঁতকে উঠছেন রেলকর্তারা। রেল বোর্ড সদস্য (ট্রাফিক) এম জামশেদ অবশ্য বলেছেন, ‘‘মেরামতি ও পর্যবেক্ষণের প্রশ্নে নিয়মমাফিক যা করার ছিল, করা হয়েছে।’’ যদিও বাস্তব বলছে অন্য কথা।

এক রেলকর্তার বক্তব্য, ‘‘টুইটার-ফেসবুকের মাধ্যমে যে রেল চলে না, তা সবার আগে বুঝতে হবে রেলমন্ত্রীকে।’’ তাঁর যুক্তি, রেলের নিরাপত্তা খাতে অবিলম্বে লোক নিয়োগ করুক মন্ত্রক। কারণ নিচুতলায় কর্মীর অভাবে ভুগছে রেল। রেলের সুরক্ষাজনিত বিষয়গুলি দেখার চাকরিতে ১ লক্ষ ২২ হাজার ৭৩৬টি পদ খালি। ফলে গাফিলতি বাড়ছে। ফি-বছর লাইনের আধুনিকীকরণ বা আধুনিক প্রযুক্তির কোচ উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, গত কয়েক বছরে তার অর্ধেকও ছুঁতে পারেনি রেল। টাকা বরাদ্দ হয়নি নিরাপত্তা তহবিলে। যে কারণে থমকে রয়েছে সুরক্ষা সংক্রান্ত অধিকাংশ কাজ।

দুর্ঘটনার সালতামামি

• ৬ ডিসেম্বর: উত্তরবঙ্গে লাইনচ্যুত পটনা-গুয়াহাটি ক্যাপিটাল এক্সপ্রেসের দু’টি কামরা। মৃত ২, আহত ১০।

• ২০ নভেম্বর: কানপুরে পটনা-ইনদওর এক্সপ্রেসের ১৪টি কামরা লাইনচ্যুত। মৃত ১৪০, জখম ১৮০।

• ৩০ সেপ্টেম্বর: কটকে ভুবনেশ্বর-ভদ্রক ট্রেন ও মালগাড়ির সংঘর্ষ। মৃত ২, আহত ২৭।

• ২৬ জুলাই: উত্তরপ্রদেশে ট্রেনের সঙ্গে স্কুল ভ্যানের সংঘর্ষ। মৃত ৮ শিশু।

• ১ মে: উত্তরপ্রদেশের হাপুরের কাছে লাইনচ্যুত পুরনো দিল্লি-ফৈজাবাদ এক্সপ্রেসের ৮টি কামরা। আহত ৪০-৫০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন