অগ্নিকাণ্ডের পরে ভস্মীভূত গোয়ার আরপোরার সেই নৈশক্লাব। ছবি: পিটিআই।
শনিবারের রাত! ক্লাবে তখন একের পর এক গান বাজাচ্ছেন ডিজে। চলছে উদ্দাম নাচ। নিমেষেই আগুনে সব ছারখার। আগুন যখন নিভেছিল, তখন ২৫টি দগ্ধ দেহ পড়েছিল গোয়ার আরপোরার ‘বার্চ বাই রোমিয়ো লেন’ নৈশক্লাবের বেসমেন্টে। কৃর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মৃতদের মধ্যে ২০ জনই ক্লাবের কর্মী। বাকি পাঁচ জন ভিন্রাজ্য থেকে বেড়াতে এসেছিলেন গোয়ায়। ২৫ জনের দেহই শনাক্ত করা গিয়েছে। এই ঘটনায় গোয়া সরকারের তিন আধিকারিককে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করা হয়েছে।
এই ঘটনার পরে আঙুল উঠেছে গোয়ার নৈশক্লাব কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র ছাড়াই চলছিল সেই ক্লাব। শনিবার রাতে যখন আগুন লাগে, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ১০০ জন অতিথি। সূত্রের খবর, আরপোরার ওই নৈশক্লাব থেকে বার হওয়ার জন্য ছিল মাত্র দু’টি দরজা। আগুন লেগেছে দেখার পরেই সেখানে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। অনেকেই নেমে যান বেসমেন্ট রান্নার জায়গায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের একটি সূত্র বলছে, সেখানেই তাঁরা কর্মীদের সঙ্গে পুড়ে দমবন্ধ হয়ে মরেন। কারণ, নৈশক্লাব থেকে বার হওয়ার পথ খুঁজে পাননি তাঁরা। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃত ২৫ জনের মধ্যে ২৩ জনের শরীরে পুড়ে যাওয়ার তেমন চিহ্ন নেই। মাত্র দু’টি দেহ ঝলসে গিয়েছে। তা থেকে অনুমান, ওই ২৩ জন নৈশক্লাবের বেসমেন্টে আটকে পড়ে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন।
ক্লাবের কর্মীদের একটি সূত্র বলছে, সেখানকার সব আসবাব ছিল কাঠের। কাঠামোও ছিল কাঠের। আর সেটাই কাল হয়েছে, এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারীদের একটি অংশ। তাঁদের মতে, কাঠের আসবাবের কারণে জতুগৃহে পরিণত হয় নৈশক্লাব। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এই ঘটনায় প্রাণ হারান ২৫ জন। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, রবিবার রাত পর্যন্ত ১৭টি দেহের ময়নাতদন্ত হয়ে গিয়েছে। পাঁচ জনের দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনায় গোয়া সরকারের তিন আধিকারিককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পঞ্চায়েতের ডিরেক্টর সিদ্ধি তুলসী হরলঙ্কার, গোয়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সচিব শমিলা মন্টেরিয়ো, আরপোরা গ্রাম পঞ্চায়েতে সচিব রঘুবীর বাগকর। ২০২৩ সালে এই নৈশক্লাব চালু করার অনুমতি দিয়েছেন বলে তিন জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাবন্ত।
দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু
মৃত ২৫ জনের মধ্যে ২৩ জনের শরীরে ঝলসে যাওয়ার চিহ্ন মেলেনি। দমকল সূত্রে খবর, বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে ধোঁয়ার কারণে দমবন্ধ হয়ে। হায়দরাবাদ থেকে গিয়েছিলেন ফতিমা শেখ। তিনিও ওই নৈশক্লাবে ছিলেন। ফতিমা জানান, ক্লাবে আগুন লাগার পরে বেশির ভাগ পর্যটক বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কয়েক জন বেসমেন্টে আশ্রয় নেন। আগুনের সঙ্গে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া গ্রাস করে সেই বেসমেন্ট। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল সকলের। ফতিমা জানান, যাঁরা ভিতরে আটকে পড়েছিলেন, তাঁদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘বেসমেন্টে রান্নাঘর ছিল। সেখানে কাজ করছিলেন কয়েক জন কর্মী। আশ্রয় নিতে কয়েক জন পর্যটক সেখানে ঢুকে পড়েন।’’
গ্রেফতার, পলাতক
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জেনারেল ম্যানেজারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে ঘটনার পর থেকেই খোঁজ নেই ওই ক্লাবের মালিকের। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সবন্তকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এফআইআর দায়ের হয়েছে। ইতিমধ্যেই ক্লাবের জেনারেল ম্যানেজার এবং কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ক্লাবের মালিকের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। প্রমোদের কথায়, ‘‘এই ঘটনার জন্য যাঁরা যাঁরা দোষী, কাউকে রেয়াত করা হবে না।’’ গোটা ঘটনার উপর নজর রাখছেন গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী।
ছাড়পত্র নেই
গোয়ার নৈশক্লাবে অগ্নিকাণ্ডে উঠছে গাফিলতির অভিযোগ। ক্লাবের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক ছিল তো? প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই নৈশক্লাবে অগ্নি নিরাপত্তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। ছিল না দমকলের ছাড়পত্রও (এনওসি)! তার পরেও কী ভাবে দিনের পর দিন ক্লাবটি চলছিল, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। গোয়ার অগ্নিনির্বাপণ এবং জরুরি পরিষেবার ডিরেক্টর নীতিন ভি. রাইকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ক্লাবটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে জানান, প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র ছিল না ক্লাবটির। কী ভাবে ওই ক্লাবে আগুন লাগল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রাথমিক ধারণা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেই এই অগ্নিকাণ্ড। তবে অন্য কোনও কারণ রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান রাইকার। দমকল দফতরের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুসরণ করেননি ওই ক্লাব কর্তৃপক্ষ, দাবি রাইকার। ছিল না পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।
নর্তকীর অভিজ্ঞতা
অগ্নিকাণ্ডের সময় মঞ্চে নাচছিলেন কাজ়াখস্তানের পেশাদার নৃত্যশিল্পী ক্রিস্টিনা। সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’কে ক্রিস্টিনা জানিয়েছেন, নাচের মাঝে আচমকা হইচই শুরু হয়ে যায়। কী করবেন, প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। নৈশক্লাবের এক কর্মীর তৎপরতায় কোনও মতে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পান তিনি। ক্রিস্টিনার কথায়, ‘‘রাতের দ্বিতীয় নৃত্য পরিবেশন করছিলাম। হঠাৎ ক্লাবে আগুন লেগে যায়। গান বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুরুতে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে। সকলের মতো আমিও বেরোনোর পথ খুঁজতে শুরু করে দিই!’’ শনিবার রাতের কথা মনে পড়লেও শিউরে উঠছেন এক সন্তানের মা ওই তরুণী।
আরপোরা নদীর ধারে রয়েছে ওই নৈশক্লাব। মঞ্চে তখন চলছিল ‘শোলে’ ছবির ‘মেহবুবা ও মেহবুবা’ গান। গানের তালে তালে নাচছিলেন কাজ়াখস্তানের নর্তকী। আসর যখন বেশ জমে উঠেছে, তখনই আচমকা মঞ্চের পিছনে আগুনের হলকা নজরে আসে দর্শকদের। সঙ্গে ধোঁয়া। পরমুহূর্তেই গান থেমে যায়। মঞ্চে থাকা শিল্পীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেরোনোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায় গোটা হলঘরে। সকলে প্রাণভয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় দমকল। ক্লাবে প্রবেশ এবং বার হওয়ার রাস্তাও খুব একটা চওড়া নয়। ফলে দমকলের গাড়ি সেখানে ঢোকাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। ৪০০ মিটার দূরেই দমকলের গাড়ি দাঁড় করাতে হয়। তার পর দমকলকর্মীরা আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। কিন্তু তত ক্ষণে ক্লাবের বেশির ভাগ অংশই পুড়ে গিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ক্লাবের বেসমেন্ট থেকে কয়েক জনকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। চার জনকে ঝলসানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। দমকলের প্রাথমিক অনুমান, সিলিন্ডার ফেটে এই বিপত্তি।