আগে যা ছিল দু-মুখো নীতি, এখন সেটিই দু-ফালি হয়ে গিয়েছে।
সারদা নিয়ে হইচইয়ের সময় বিজেপির ছিল দ্বিমুখী নীতি। নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের খাতিরে সখ্য রাখবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সিবিআই নিজের গতিতে কাজ করবে। আর দলের সভাপতি হিসেবে অমিত শাহ নেবেন রণং দেহি রূপ। কিন্তু ভোটের সময় প্রতিপক্ষের সঙ্গে কীসেরই বা সখ্য? তা-ও যখন হাতগরম নারদের মতো একটি ইস্যু চলে এসেছে! সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্ত ঢিলে হওয়ার অভিযোগের আবহে নারদের তদন্ত চাপে রাখতে পারত মমতাকে। রাজ্য নেতৃত্বের চাপে অমিত শাহ ঝাঁঝালো আক্রমণই শানাতে চাইছেন বাংলায়। কিন্তু অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহরা এখনই মমতাকে খুব বেশি চটানোর পক্ষে নন।
যার ফলে বিজেপি এখন কার্যত দ্বিধাবিভক্ত।
সারদার সময় সিবিআই নিয়ে একটি হাওয়া তৈরি করেছিলেন সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। নারদের ভিডিও প্রকাশের দিন রাজ্য নেতৃত্বের হয়ে কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে বাজার কিছুটা গরম করে এসেছেন। এখন দিল্লি ফিরেই সটান নালিশ করেছেন অমিত শাহের কাছে। ক্ষোভ উগরে বলেন, রাজ্যে দল নিজেদের ভিত তৈরির চেষ্টা করছে। নারদের খোলসা নিয়ে শেষ বাজারে বিজেপি ঝাঁপাতে পারে দিল্লি থেকে একটু সাহায্য পেলেই। সিবিআই দাবি নিয়ে মমতার উপর চাপ বাড়ানোর ভরপুর মওকা। কিন্তু দিল্লি থেকে কোনও হেলদোল নেই। এমনিতেই সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্ত ঢিলেতালে চলছে বলে বিরোধীরা তৃণমূলের সঙ্গে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ আনছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি ভোটের মুখে নারদ নিয়েও একটু সক্রিয় হত, তা হলে বিজেপিরই লাভ হত। নীতি কমিটিতে বিষয়টি গেলেও তার সুপারিশ আসতে আসতে ভোট কেটে যাবে। এখন দরকার ছিল তদন্তের হাওয়া তোলা। কিন্তু লোকসভায় দলের দুই-এক জন মুখ খুললেও অরুণ জেটলির নেতৃত্বে রাজ্যসভা নীরব।
দলের সূত্রের মতে, বাংলায় ভোট বাড়িয়ে আর কিছু আসন বের করে নিজের সাফল্যের একটি ছবিও মেলে ধরতে চান অমিত শাহ। নতুন করে সভাপতি হয়ে পাঁচ রাজ্যে তাঁর কঠিন পরীক্ষা। ফলে মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হতেই চাইছেন তিনি। আরএসএসও বিধানসভায় লোকসভা নির্বাচনের ভিত তৈরি করে রাখতে চায়। রাজ্য নেতৃত্বের ক্ষোভ দেখে বিষয়টি নিয়ে জেটলির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন অমিত শাহ। সিদ্ধার্থ কথা বলেন বেঙ্কাইয়া নায়ডুর সঙ্গেও। যার পরেই বেঙ্কাইয়া লোকসভায় সরকারি তদন্ত অথবা নীতি কমিটিতে পাঠানোর কথা বলেন। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্বের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশের বক্তব্য আদৌ জোরালো নয়। এখনও পর্যন্ত দলের কোনও শীর্ষ নেতা এই নিয়ে সরব হননি। কেন্দ্র তদন্ত নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেই বাকিটা রাজ্য নেতারা সামলে নিতেন নিজেদের মতো করে।
কিন্তু রাজ্য নেতারা মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হতে চাইলেও অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহেরা এখনও কেন সরব হচ্ছেন না?
জেটলি ঘনিষ্ঠ এক নেতার মতে, বিজেপির প্রধান শত্রু তৃণমূল নয়, কংগ্রেস। আজ যদি রাজ্যে-রাজ্যে কংগ্রেসের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, তা হলে তো লোকসান বিজেপিরই। অসমে যদি ফের কংগ্রেস ক্ষমতা টিকিয়ে নেয়, সরাসরি আঘাত তো বিজেপির উপরে। পশ্চিমবঙ্গে বামেদের সঙ্গে জোট করে কংগ্রেস যদি ভাল ফল করে, তা হলে তো কেন্দ্রে তাদেরই শক্তি বাড়বে। এই শিবিরের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘তার মানে এই নয়, বিজেপি আশা করে বসে আছে মমতা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দলে আসবেন। কিন্তু জয়ললিতার মতো বাইরে থেকেও তো কখনও-সখনও বন্ধুত্ব কাজে লাগে। কিংবা মায়াবতী-মুলায়মের মতো। রাজ্যসভায় যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হওয়ার সুযোগ নেই, তখন এই দলগুলির উপরেই মাঝেমধ্যে ভরসা রাখতে হয়।’’
যার ফলে মমতাকে চটানোর পক্ষে নন বিজেপির এই নেতারা। মমতা ও বিজেপির এই ‘অলিখিত’ বোঝাপড়া নিয়ে আজও সীতারাম ইয়েচুরি সংসদে সরব হয়েছেন। বলেছেন, ম্যাচ গড়াপেটা চলছে বিজেপি-তৃণমূলের। যা দেখে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, গড়াপেটার অভিযোগ মিথ্যে। সংসদের রেকর্ড থেকে বাদ দিতে হবে।