তৃণমূল-বিজেপি সংঘাত, দক্ষযজ্ঞ লোকসভায়

আকস্মিক পটপরিবর্তন। তাপস পালের মন্তব্যের পর রাজনৈতিক আচরণবিধির প্রশ্নে কাঠগড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল তৃণমূল। আজ বিজেপি-র এক সাংসদ, গোটা চিত্রটি কিছুটা হলেও ঘুরিয়ে দিলেন। যার জেরে ওই একই প্রশ্ন নিয়ে সংসদের অভ্যন্তরে এবং গাঁধীমূর্তির পাদদেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:৩৯
Share:

সংসদের বাইরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি তৃণমূল নেতারা। ছবি: পিটিআই।

আকস্মিক পটপরিবর্তন।

Advertisement

তাপস পালের মন্তব্যের পর রাজনৈতিক আচরণবিধির প্রশ্নে কাঠগড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল তৃণমূল। আজ বিজেপি-র এক সাংসদ, গোটা চিত্রটি কিছুটা হলেও ঘুরিয়ে দিলেন। যার জেরে ওই একই প্রশ্ন নিয়ে সংসদের অভ্যন্তরে এবং গাঁধীমূর্তির পাদদেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি সাংসদ হরিনারায়ণ রাজভার তৃণমূল নেত্রী এবং কতিপয় মহিলা সাংসদের উদ্দেশে ছাপার অযোগ্য ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তাঁদের ‘বিবস্ত্র করে পেটানোর’ হুমকিও দিয়েছেন বলে অভিযোগ। এই সাংসদকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি করেছে তৃণমূল। অন্য দিকে, অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে রাজভার জানিয়েছেন, “আমি কেন মেয়েদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করব? বরং তৃণমূলের সাংসদরাই তো মোদীজিকে চোর বলেছেন।”

গোটা ঘটনার জেরে রেল বাজেটের দিনে দক্ষযজ্ঞের সাক্ষী হতে হল লোকসভাকে। অন্য দিকে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং আচরণবিধি নিয়ে প্রশ্ন আরও বড় হয়ে উঠল খোদ গণতন্ত্রের পীঠস্থানেই।

Advertisement

সকাল থেকেই বিজেপি-তৃণমূলের কাজিয়ায় উত্তপ্ত হচ্ছিল লোকসভা। বাজেটে পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা করা হয়েছে এবং রেলের ভাড়া বৃদ্ধি সরকার প্রত্যাহার করেনিএই দুইয়ের প্রতিবাদে বার বার ওয়েলে এসে লোকসভা অচল করেছেন তৃণমূল সাংসদরা। স্লোগান দিয়েছেন, ‘নরেন্দ্র মোদী হায় হায়’। বিশেষ কিছু শিল্পগোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই এই বাজেট করা হয়েছে--- এমন অভিযোগে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বার বার সরব হয়েছে তৃণমূল বেঞ্চ। রেল বাজেট পেশের পর দ্বিতীয় দফায় অধিবেশনে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু শুরু হওয়ার পর থেকেই মূলত তৃণমূলের বিক্ষোভে বার বার মুলতুবি হয় লোকসভা। তিনটের পরে উত্তেজনা চরমে পৌঁছয়। ওয়েলে তখন সদ্য পেশ হওয়া রেল বাজেট এবং মোদী-বিরোধী আওয়াজ তুলছেন তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অপরূপা পোদ্দার, শতাব্দী রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যেপাধ্যায়-সহ অন্যান্য সাংসদ। ছিলেন সন্ধ্যা রায়, মুনমুন সেনও। উত্তরপ্রদেশের ঘোসি থেকে জিতে আসা বিজেপি সাংসদ হরিনারায়ণ রাজভারের সঙ্গে ওই সময়েই বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় কল্যাণকে। এর পর নিজের আসন থেকে মারমুখী ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়াতে দেখা যায় রাজভারকে। তিনি হাত পা নেড়ে চিৎকার করতে থাকেন। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে অধিবেশন মুলতবি করে দেন স্পিকার। এর পরই শুরু হয় আসল নাটক। অভিযোগ, রাজভার চেঁচিয়ে একটি অসংসদীয় মন্তব্য করেন তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে। সেটি শুনেই পিছন থেকে ছুটে আসেন অভিষেক, প্রসূন, কল্যাণেরা। প্রায় হাতাহাতির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সামনে ছিলেন তৃণমূলের মহিলা সাংসদরা। তাঁদের সম্মিলিত অভিযোগ, “আমাদের কাপড় খুলে মারার হুমকি দেওয়া হয়েছে।” পরিস্থিতি যখন আরও খারাপের দিকে, দৌড়ে আসেন মার্শালরা। রাজভার এবং তৃণমূল সাংসদের মাঝে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন।

এর পরেই প্রায় দৌড়ে সংসদ থেকে বেরিয়ে গাঁধী মূর্তির তলায় চলে আসেন দৃশ্যতই ক্ষোভে বিহ্বল কল্যাণ, কাকলি, প্রসূন, অভিষেকরা। ছিলেন নতুন সাংসদ অনুপম হাজরা, সৌমিত্র খানেরাও। আতঙ্কগ্রস্ত এবং ক্ষুব্ধ কল্যাণকে বলতে শোনা যায়, “বিজেপি-র সাংসদ আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছে। মহিলাদের জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে।” কাকলির কথায়, “এর পর তো সংসদে আসতেই ভয় করবে আমাদের। সংসদের ভিতরেই মহিলা সাংসদদের প্রতি যদি এমন ব্যবহার করা হয়, তা হলে দেশের নাগরিকদের কী হবে তাই নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কিত আমরা।” তৃণমূল স্পিকারের কাছেও এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে। আগামী দিনে আন্দোলনেরও হুমকি দিয়েছে তারা।

সাড়ে চারটেয় সংসদ খোলার পর ওই উত্তপ্ত পরিবেশেই সৌগত রায় প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের বেশ কিছু রাজ্যের জন্য কোনও প্রকল্প বরাদ্দ না-হওয়া এবং বর্ধিত রেলভাড়া প্রত্যাহার না করার জন্য তৃণমূলের সাংসদেরা ওয়েলে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। আমাদের মহিলা সাংসদেরাও প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। এমন সময় শাসক দলের এক সাংসদ ছুটে আসেন আমাদের মারার জন্য। নোংরা ভাষা ব্যবহার করেন আমাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে। হুমকিও দেওয়া হয় যে মহিলাদের কাপড় খুলে মারা হবে।” সৌগতবাবুর বক্তব্যের পরে উত্তেজনা চড়তে থাকে। প্রকাশ জাভড়েকর এর পর পরিস্থিতি সামলাতে যা বলেন তাতে উত্তাপ কিন্তু আরও বেড়ে যায়। তাঁর কথায়, “বিষয়টি খুব সহজ। এখানে অনেক নতুন সদস্য এসেছেন। সরকার নির্বাচিত হয়েছে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে।” তাঁর এই কথায় হট্টগোল তৈরি হয় কার্যত গোটা বিরোধী বেঞ্চ থেকেই। তৃণমূলের প্রমীলা বাহিনী প্রশ্ন তুলতে থাকেন, বিপুল জনাদেশ পাওয়ার অর্থ কি তা হলে এই যে, নারীদের অবমাননা করা যাবে?”

এই প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে লোকসভা আবার মুলতুবি করে দেন স্পিকার। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ সকালেই বিষয়টি নিয়ে সংসদে সরব হয়েছিলেন খোদ স্পিকার সুমিত্রা মহাজনই। সকালে রেল বাজেট পেশ করার আগে কংগ্রেস সাংসদ রঞ্জনা রঞ্জন, তাপস পালের সাম্প্রতিক মন্তব্যটির প্রসঙ্গ তোলেন। পাশাপাশি বিজেপি-র কিষান মোর্চার প্রধান ও পি ধানকারের মহিলা ‘অবমাননা’র প্রসঙ্গটিও তোলেন তিনি। স্পিকারের কাছে রঞ্জনার অভিযোগ, সব ক্ষেত্রেই মহিলাদের টেনে এনে অপমান করা হবে কেন? জবাবে স্পিকার একটি লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন। তাপস পাল-সহ দু’টি ঘটনারই নিন্দা করেছেন স্পিকার। তাঁর কথায়, “যাঁরা সংসদের উচ্চপদে বসে রয়েছেন তাঁদের এমন কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়, যাতে দেশের মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অবমাননা হয়। এমন ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে তার জন্য আমাদের সবারই চেষ্টা করতে হবে।” সংসদে দলীয় সাংসদের নিগৃহীত হওয়ার প্রসঙ্গে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, “লোকসভা গণতন্ত্রের পীঠস্থান। আমাদের সাংসদদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা শুনেছি। এটা অত্যন্ত অন্যায়, দুঃখের। আসলে মুখ বন্ধ করতেই এ সব করা হচ্ছে।” অন্য দিকে, বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র মন্তব্য,“ ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম না। তবে কাউকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় আক্রমণ করা হয়ে থাকলে, আমি তার নিন্দা করছি।”

সংসদে এই ঘটনা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পক্ষে যে বিপজ্জনক তা এক বাক্যে মেনে নিচ্ছেন রাজনৈতিক শিবিরের সকলেই। কিন্তু তাঁদের একাংশের মতে, তৃণমূলের এই আগ্রাসী রণনীতির পিছনে রয়েছে বিরোধী দলের স্থান দখলের চেষ্টা। কংগ্রেস মূল বিরোধীর আসন হারালে তৃণমূল, বিজেপি-উভয় দলেরই লাভ। সেই খেলা খেলতে গিয়েই আজ বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

যে বাড়াবাড়িতে সংসদের ইতিহাসে সৃষ্টি হল লজ্জাজনক এক নজির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন