রাজীব কুমার। ফাইল চিত্র
শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্যের উপরে চাপ বাড়াল কেন্দ্র।
রবিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্নামঞ্চে উপস্থিত হয়ে রাজীব কুমার চাকরির শর্ত ভেঙেছেন বলে আগেই জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও। আজ একেবারে রাজ্যের মুখ্যসচিব মলয় দে-কে চিঠি লিখে রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে পদক্ষেপ করার অনুরোধ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজীব গৌবা। ওই অফিসারের বিরুদ্ধে রাজ্য প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিল, তা-ও বিশদে কেন্দ্রকে জানাতে বলা হয়েছে নবান্নকে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া হলফনামায় সিবিআই-ও ধর্নামঞ্চে থাকার জন্য রাজীব কুমারের সমালোচনা করেছে।
একে অবশ্য রাজ্যের উপর কেন্দ্রের চাপ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখছে তৃণমূল শিবির। দলের এক সাংসদের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় ক্যাডার হওয়ায় সিবিআই প্রধান অলোক বর্মাকে মাঝ রাতে সরিয়ে দিতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু এখানে রাজীব কুমার রাজ্যে কর্মরত রয়েছেন বলে সরাসরি কিছু করতে পারছে না। তাই রাগে ফুঁসছেন মোদী-অমিত শাহেরা। এখন ঘুরপথে রাজীব কুমার-সহ রাজ্য প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলার রাজনীতি করতে চাইছে শাসক শিবির।’’
আরও পড়ুন: সিপি-র নামে অভিযোগে তৃণমূলের দিকেও আঙুল
যদিও ওই অভিযোগ উড়িয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, যা করা হচ্ছে, তা নিয়ম মেনেই। কারণ কোনও আমলা কোনও রাজনৈতিক মঞ্চে উপস্থিত থাকতে পারেন না। রাজীব কুমার রবিবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর ধর্নামঞ্চে উপস্থিত থেকে চাকরির সেই শর্ত ভেঙেছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আজ মুখ্যসচিব মলয় দে-কে লেখা চিঠিতে কেন্দ্র জানিয়েছে, গত রবিরার মেট্রো চ্যানেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজীব কুমার-সহ বেশ কিছু পুলিশ অফিসার ধর্নায় উপস্থিত ছিলেন বলে জানতে পেরেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এতে তাঁরা অল ইন্ডিয়া সার্ভিস (কন্ডাক্ট) আইনের ৩(১), ৫(১) এবং ৭ নম্বর ধারাকে অবজ্ঞা করেছেন বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
আইনের ওই ধারাগুলি ব্যাখ্যা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, কোনও চাকুরিরত আমলা কোনও ভাবেই কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। বা রাজনীতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। রেডিয়ো বা অন্য মাধ্যমের সাহায্যে নিজের নামে, ছদ্মনামে বক্তব্য রাখা বা সংবাদমাধ্যমের সামনে কেন্দ্র বা রাজ্যের নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অধিকারও আমলাদের নেই, যাতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক খারাপ হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ধর্নামঞ্চে থেকে ৫(১) ধারা লঙ্ঘন করেছেন পুলিশ কমিশনার।
কেন্দ্র চাপ দিলেও সূত্র বলছে বিষয়টি নিয়ে ধীরে চলার পক্ষপাতী রাজ্য সরকার। রাজ্য প্রশাসনের মতে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী থাকেন, সেখানে প্রয়োজনে যে কোনও পুলিশ আধিকারিক দেখা করতে পারেন। এমনকি নির্বাচনের সময়েও তা করা যায়। তাতে নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন হয় না। তা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক প্রধান। আইনশৃঙ্খলা বা সরকারি কাজ সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করার জন্য আমলারা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতেই পারেন। এর মধ্যে রাজনীতির কোনও বিষয় নেই।
ধর্না প্রত্যাহার করার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজীব কুমার সম্পর্কে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজীব কুমার কোনও দিন এই ধর্নায় যোগ দেননি। এটা নির্জলা মিথ্যা। কেউ দেখেছেন তাঁকে ধর্নামঞ্চে উঠতে? রাজীব কিছু করেননি। রাজীব কুমার কি ওঁদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছেন? আমি মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীরা যেখানে যান, তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ সুপার, কমিশনাররা সেখানে যান। এটাই প্রোটোকল। সোমবার ক্যাবিনেট বৈঠক এই ধর্নামঞ্চের পিছনে আলাদা একটা ঘরে করেছি। ফাইল সই করেছি। রাজীব আমার সঙ্গে এখানে কথা বলতে আসতে পারে না? আমার সঙ্গে কথা বলতেই এসেছে। ওরা ওদের কর্তব্য করেছে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যেখানে রাজনৈতিক সভা করতে যান, সেখানে তো এসপিজি থাকে। তা হলে রাজীব আমার এই ধর্নামঞ্চের নীচে এসে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে না কেন? ঠাকুরনগরে মিটিং করতে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানেও তো এসপিজি ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘চিঠির জবাব দিয়ে দেব আমরা। ওরা যে চিঠিটা দিয়েছে, মূল্যহীন, অর্থহীন, বিবেচনাহীন। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কাজ করছে। ভেরি ম্যাড, ভেরি স্যাড, ভেরি ব্যাড।’’
প্রশাসনিক নিয়মকানুন
এ ধরনের নির্দেশ এলে সাধারণত কী করা হয় ?
প্রশাসনিক ব্যাখ্যায়, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত অফিসারকে কারণ দর্শানোর নোটিসের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র দফতর জানতে চায়, কেন তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া (ডিসিপ্লিনারি প্রসিডিং) শুরু করা হবে না। উত্তর সন্তোষজনক না হলে গঠিত হয় ‘চার্জ’। একইসঙ্গে, ‘ডিসিপ্লিনারি অথরিটি’ হিসাবে এক প্রশাসনিক কর্তার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। শুনানি, তথ্যপ্রমাণ জোগাড় এবং সাক্ষীদের বয়ান তৈরির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে রিপোর্ট জমা পড়ে ‘ডিসিপ্লিনারি অথরিটি’র কাছে। অভিযুক্ত অফিসারের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে শাস্তির প্রস্তাব করেন তিনি। সাধারণ ভাবে ‘ডিসিপ্লিনারি অথরিটি’র দায়িত্ব সামলাতে হয় রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকেই।
রাজ্য কি কেন্দ্রের পরামর্শ মানতে বাধ্য?
প্রশাসনের অন্দরের যুক্তি, দেশের রাষ্ট্রপতি আইপিএস অফিসারদের নিয়োগকর্তা। রাষ্ট্রপতির হয়ে ওই অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। মন্ত্রক রাষ্ট্রপতির হয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধে রাজ্যকে কোনও নির্দেশ পাঠায়। ফলে রাজ্যকে তা মানতেই হয়। কিন্তু যদি রাজ্য তা না মানে, সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত অফিসারকে অপসারণের মতো পদক্ষেপ করতেই পারে মন্ত্রক। রাজ্যের যে অফিসারকে মন্ত্রক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করতে পারে কেন্দ্র। সেই অফিসার আইএএস হলে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের নিয়ন্ত্রক ‘ডিওপিটি’ সেই পদক্ষেপ করতে পারে।