Indian citizenship

ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ভারতে আগত অমুসলিমদের নাগরিক হওয়ার আর্জি জানানোর মেয়াদ বাড়ল, লক্ষ্য বাংলা ও অসমের ভোট

২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল সংসদে পাশ হয়েছিল অভিবাসন এবং বিদেশি আইন। যার উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। কোন কোন বিদেশি ভারতে ঢুকবেন, কী ভাবে ঢুকবেন, কী নথি থাকলে তবেই ঢুকতে পারবেন, সে সব বিষয়ে ভারত সরকারের হাতে কী কী ক্ষমতা থাকবে, আইনে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বলা রয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:২৬
Share:

ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত।

আগামী বছরে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে বিধানসভা ভোটের আগে বড় পদক্ষেপ করল কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দিল, ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বা ধর্মীয় নিপীড়নের ভয়ে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে আসা, হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হবে। ভারত সরকার তাঁদের তাড়িয়ে দেবে না।

Advertisement

এই নির্দেশনামার নিহিত অর্থ, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার হয়ে বা ধর্মীয় উৎপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে যে সব হিন্দু বাঙালি মূলত পশ্চিমবঙ্গ, অসম এবং ত্রিপুরায় পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের কাছে বৈধ কাগজপত্র থাক বা না-থাক, যদি তাঁদের ভিসার মেয়াদ ফুরিয়েও যায়, তাঁরা সকলেই শরণার্থীর মর্যাদা পাবেন। ভারতে থাকতে পারবেন।

গত ১ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। যার শুরুতেই বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল কার্যকর হওয়া অভিবাসন এবং বিদেশি আইনের ৩৩ ধারা অনুযায়ী এই বিজ্ঞপ্তি। যে আইন পাশ হয়েছিল সংসদে গত বাজেট অধিবেশনের সময়ে। যার প্রবল বিরোধিতাও হয়েছিল। যদিও সংখ্যার জোরে তা পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্র। বিজ্ঞপ্তির সাব সেকশন ‘ই’-তে রয়েছে আসল ‘খবর’। এই ধারাতেই কেন্দ্র জানিয়েছে, ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু বাঙালিদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হবে। তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না। অর্থাৎ, সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের হিন্দু জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যেও যে ভাবে ‘পুশব্যাক’ আতঙ্ক কাজ করছিল, তা-ও দূর করতে চাইল কেন্দ্রীয় সরকার।

Advertisement

২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল কার্যকর হওয়া অভিবাসন এবং বিদেশি আইনের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। কোন কোন বিদেশি ভারতে ঢুকবেন, কীভাবে ঢুকবেন, কী নথি থাকলে তবেই ঢুকতে পারবেন, সে সব বিষয়ে ভারত সরকারের হাতে কী কী ক্ষমতা থাকবে, এই আইনে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বলা রয়েছে। এই আইনেই বলা আছে, বৈধ পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া কেউই ভারতে প্রবেশ করতে পারবেন না। আবার এই আইনেরই ৩৩ ধারায় সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি বিচার করে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই আইনের বিভিন্ন ধারায় যা বলা আছে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার দরকারে অদলবদল করতে পারবে। পরিস্থিতি সাপেক্ষে কোনটা ‘ব্যতিক্রম’, তা-ও কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করতে পারবে। অর্থাৎ, আইন মেনেই কেন্দ্র জানিয়ে দিল, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে বা ভয়ে যে হিন্দু বাঙালিরা ভারতে পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হবে।

কিন্তু এর পরে কী? এই শরণার্থীরা কি ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, তাঁরা নাগরিকত্ব পেতেই পারেন। তবে তার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে (সিএএ) সামান্য সংশোধন করতে হবে। যে গেজেট বিজ্ঞপ্তিটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা সিএএ আইনের আওতায় জারি করা হয়নি। সেই বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও সিএএ শব্দটিরও উল্লেখ নেই। এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যাঁরা ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট’-এর অধীনস্থ হওয়া থেকে রেহাই পেয়ে গেলেন, অচিরেই তাঁদের জন্য সিএএ-তে আবেদন জানানোর পথও খুলে দেওয়া হবে। তবে তার জন্য পৃথক বিজ্ঞপ্তি বা সংশোধনী দরকার। সেখানে সংসদেরও ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কী পদক্ষেপ করতে চলেছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। অনেকের বক্তব্য, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেই সেই কাজটি সেরে ফেলতে পারেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

বস্তুত, এই বিজ্ঞপ্তিকে অনেকেই নাগরিকত্বের প্রথম ধাপ বলে মনে করছেন। নাগরিকত্ব থাকলেই প্রাপ্তবয়স্ক হলে ভোট দেওয়ার অধিকার পাওয়া যায়। অনেকের মতে, পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে ভোটার তালিকায় নিবিড় সমীক্ষার (এসআইআর) সময়ে (যা আসন্ন বলেই মনে করা হচ্ছে প্রশাসনিক তৎপরতার নিরিখে) জাতীয় নির্বাচন কমিশন বলতেই পারে, সিএএ-এর অধীনে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যাঁরা আবেদন করেছেন, আবেদনের মীমাংসা না হওয়া অবধি তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে না। এ দিকে ঘটনাক্রম এগোতে পারে। না-ও পারে। তবে সম্ভাবনা কেউই উড়িয়ে দিতে পারছেন না।

‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতা একান্ত আলোচনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই গেজেট বিজ্ঞপ্তিকে ‘অসমের খেলা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অসমের দিকে তাকিয়ে হিসাব কষেই যা করার করা হয়েছে।’’ পশ্চিমবঙ্গ কি সেই হিসাবের খাতায় নেই? জবাবে দিল্লির রাজনীতির অলিন্দে সক্রিয় ওই বিজেপি নেতা বলেন, ‘‘এই বিজ্ঞপ্তির মূল উদ্দেশ্য হল অসম। তবে বাংলাতেও এর প্রভাব পড়বে। অসম মূল শিল্প হলে পশ্চিমবঙ্গ অনুসারী শিল্প।’’

অসমে ভোটার তালিকায় ‘সন্দেহজনক’ (ডাউটফুল) বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু বাঙালি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যাঁদের মধ্যে অসমের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। এই অংশ মূলত উজানি অসমের (আপার অসম) বাসিন্দা। তবে এই ক্ষোভের প্রভাব রাজনৈতিক ভাবে তরান্বিত হচ্ছিল বরাক উপত্যকাতেও। পরিস্থিতি বুঝেই এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে বলে আপাতত অভিমত অসমের রাজনীতির ওয়াকিবহালদের অনেকের। রাজনৈতিক মহলের অনেকে আরও একটি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মূলত যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাতে সুবিধা পাবেন অমুসলিমেরা। যা রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও তীব্র করারই ‘সরকারি মোড়ক’।

বিজ্ঞপ্তি নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই উৎফুল্ল বিজেপি। সুকান্ত মজুমদার, শান্তনু ঠাকুরেরা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাল্টা তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সিএএ, এনআরসি, এসআইআর— এই সবকে এক জায়গায় করে বিজেপি আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। সেই কৌশল সফল হবে না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement