লাহোরে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পরের ছবি। ছবি: এএফপি।
ভারতীয় বাহিনী মঙ্গলবার গভীর রাতে পাকিস্তানে যা করেছে, আমি এখন সেনাধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকলে ঠিক সেটাই করতাম। শুধু আমি কেন, আমার যে কোনও পূর্বসূরি বা উত্তরসূরিরও এটাই করা উচিত। জঙ্গিদের সমস্ত ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া অবশ্যকাম্য। ভারতীয় সেনা সেটাই করেছে। আমি গর্বিত!
এখন প্রশ্ন হল, এই ‘ঘাঁটি’ বস্তুটা কী? সেটা কি তাঁবু? না কি কোনও বহুতল? আমরা কি শুধু তাঁবু বা বহুতল ধ্বংস করে এসেছি? ওখানে কারা থাকে? কী থাকে ঘাঁটির ভিতরে? আমরা কি শুধু সে সবই ধ্বংস করলাম? না কি কিছু জঙ্গিও মারলাম? কী কী নষ্ট করতে পেরেছি আমরা মঙ্গলবার গভীর রাতে, সেটা জানা খুব প্রয়োজন। আমি সেটা বিশদে এবং বিস্তারিত ভাবে জানাতে চাই।
সেনাধ্যক্ষ থাকাকালীন আমি এমন বেশ কিছু জঙ্গিঘাঁটি দেখেছি। সেগুলো পাহাড়ের চূড়ায় থাকা তাঁবু। কোনও পাকা বসত নয়। সে সব তাঁবুতে লোকজন থাকত। আমরা সব হটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বার যে ঘাঁটি নষ্ট করা হল, সেখানে যারা ছিল, তারা কোথায়? আমরা কি শুধু জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করতে পেরেছি? না কি জঙ্গিগুলোকেও মারতে পেরেছি? খবরে অবশ্য দেখলাম, প্রায় ৭০ জন জঙ্গি মারা গিয়েছে। সেটা হয়ে থাকলে খুবই ভাল। কিন্তু যারা রয়ে গেল, তাদেরও যথাসম্ভব দ্রুত নিকেশ করতে হবে। ভারতীয় সেনা দারুণ কাজ করেছে। কিন্তু আরও কিছু কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে।
আনন্দবাজার ডট কম-এ এই লেখায় একটা অপ্রিয় সত্যি কথাও একই সঙ্গে বলতে চাই। আমাদের বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ, আমরা যাকে প্রচলিত ভাবে ‘ইন্টেলিজেন্স’ বলি, সেটা কিন্তু ভয়ঙ্কর খারাপ। একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে! আমরা জঙ্গিদের ধরতে পারছি না। আমরা তাদের আগে থেকে চিহ্নিত করে মারতে পারছি না। আমরা আসলে খবরই পাচ্ছি না! মাঝেমাঝে কয়েকটা ছবি বেরোয় সংবাদমাধ্যমে, মস্তানের মতো চেহারা। ওরা নাকি জঙ্গি। ভাল তো। কিন্তু চিনতে যখন পারছি, তখন মারতে পারছি না কেন! পহেলগাঁও কাণ্ডের পরেও কয়েক জন জঙ্গির ছবি দেখলাম। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের ধরতে পারলাম না এখনও। মারতেও পারলাম না। অতএব, আমাদের ‘ইন্টেলিজেন্স’ যে করে হোক বাড়াতে হবে। গোয়েন্দাদের আরও সক্রিয় করতে হবে। নইলে আবার যে পহেলগাঁওয়ের মতো নারকীয় ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়!
আমাদের সকলের সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া দরকার। সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি করা দরকার। সেটা এ পারে। ও পারেও। কোন এলাকায় কারা কারা থাকে? তারা কী করে? তাদের কার্যকলাপ কী? জানতে হবে আমাদের। নিজের দেশে যেমন সক্রিয় গুপ্তচর রাখতে হবে, তেমনই ও পারেও গুপ্তচর রাখতে হবে। তাদের আরও সক্রিয় করতে হবে। আমার সময় থেকে এখনও পর্যন্ত প্রযুক্তি কয়েক যোজন এগিয়ে গিয়েছে। আকাশপাতাল ফারাক। কিন্তু সে সব দিয়েও আমরা অপরাধী মানুষগুলোকে ধরতে পারছি না! খবর রাখতে পারছি না। খবরটা রাখতে হবে তো। কে কী করছে-র থেকেও জরুরি খবর হল, কে কী করতে পারে, কে কী করবে। এটা যত ক্ষণ না জানতে পারব, তত ক্ষণ ওরা আমাদের এ ভাবেই হয়রান করবে। আমি এখন সেনাধ্যক্ষ থাকলে ‘ইন্টেলিজেন্স’ আরও বাড়াতাম। সীমানার দু’পারে আরও গুপ্তচর রাখতাম। তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়াতাম। কলকাতা পুলিশও এই নিয়ম মেনে চলে দেখি। তা হলে ভারতীয় সেনা কেন নয়!
এখন ড্রোন প্রযুক্তি এসেছে। অত্যাধুনিক অস্ত্র এসেছে। হাতের নাগালে অনেক কিছু রয়েছে। সে সব দিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। জোর দিয়ে বলছি, ইন্টেলিজেন্সের মতো নজরদারিতেও আমাদের খামতি থেকে যাচ্ছে। মনুসংহিতায় সেই কবেই বলা হয়েছে সাম, দান, দণ্ড, ভেদ— এই চার নীতির কথা। ‘সাম’ বলতে বোঝায় পরস্পরের অনিষ্ট চিন্তা না-করে সহায়তা প্রদানের শর্তে শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করা। প্রতিবেশীদের মধ্যে এই সাম-নীতির প্রয়োজন থাকে। কিন্তু যেখানে এই সূত্র কাজ করবে না, সেখানে তো দণ্ডের কথাই বলা রয়েছে। দরকারে আমি কেন দণ্ড দেব না? সে তো অন্যায় নয়।
আমি দণ্ডে বিশ্বাস করি। এখন আমি ভারতীয় সেনার দায়িত্বে থাকলে ওই ঘাঁটিগুলো যেমন গুঁড়িয়ে দিয়ে আসতাম, তেমনই চেষ্টা করতাম সমস্ত জঙ্গিকে নিকেশ করতে। ওই সব ঘাঁটিতে যারা থাকে, তাদের সকলকে উড়িয়ে দিতাম। কাউকে ছাড়তাম না! তাতে হয়তো কিছু নিরীহ লোক মারা যেত। কিন্তু কিছু করার নেই। শুধু বলব, ‘ব্যাড লাক’। তাদের কপাল খারাপ। সাধারণ লোক হলে তুমি জঙ্গিঘাঁটির কাছাকাছি গিয়েছ কেন? জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছ কেন?
পহেলগাঁওয়ে যারা গুলি করে মানুষ মেরেছিল, তারা তো কোনও ধর্ম মানে না। কোরানেও তো নিরীহ মানুষকে মারার কথা বলা নেই। তা হলে তো ওই জঙ্গিরা ইসলামও মানে না। ওদের একটাই পরিচয়— ওরা জঙ্গি! ওদের একটাই শাস্তি— সমূলে বিনাশ! সে রাইফেল দিয়ে হোক বা রাফাল দিয়ে, ওদের শেষ করতেই হবে। তবে পাশাপাশিই খেয়াল রাখতে হবে, বিষয়টা যেন পারমাণবিক বোমা পর্যন্ত না-পৌঁছোয়।
আবার বলি, আমি পাকিস্তানে ঢুকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই হামলায় ভীষণ খুশি। আমি থাকলে ঠিক এটাই করতাম!
(লেখক দেশের প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ। মতামত তাঁর নিজস্ব। নিবন্ধটি তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)