নোট বাতিল নিয়ে বিরোধী দলগুলির বিক্ষোভের মধ্যে বেঙ্কাইয়া নায়ডু বলেছেন, ‘‘পিছিয়ে আসা নরেন্দ্র মোদীর রক্তেই নেই।’’ তবে মোদী সরকার মুখে যতই কঠোর মনোভাব দেখাক, তাদের নিজেদের ঘরেই এখন চরম অশান্তি। মোদীর বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন পরিচিত বিক্ষুব্ধরা। আর শরীরের ভিতরে রক্তক্ষরণের মতোই বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের অন্দরে মোদী-বিরোধী অসন্তোষ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে।
বিজেপির পটনার সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হা এ দিন তোপ দেগেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। টুইটারে তাঁর মন্তব্য, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে দেশের সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের শিকার। প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে শত্রুঘ্ন বলেন, আচমকা নেমে আসা বিপদের থেকে বাঁচতে মা-বোনেরা যে টাকা জমান, তাকে কালো টাকার সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। আর নোট বাতিলে তাঁর প্রতি সমর্থন বাড়ছে ভেবে প্রধানমন্ত্রী যাতে ‘মূর্খের স্বর্গে’ বাস না করেন, সেই হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন আডবাণী-ঘনিষ্ঠ এই বিজেপি নেতা। শত্রুঘ্নই শুধু নন, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, অরুণ শৌরির মতো নেতারাও এখন মানুষের ভোগান্তির জন্য প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করছেন। দুঁদে আইনজীবী তথা অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী রাম জেঠমলানী প্রকাশ্যে মোদীর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। বিজেপি-ঘনিষ্ঠ এই নেতা বলেছেন, ‘‘মোদীর বিরোধিতা করতে এই বয়সে আমাকে আবার সুপ্রিম কোর্টে যেতে হবে।’’ গুজরাতের প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক যতীন ওঝা মোদীকে খোলা চিঠি দিয়ে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। এমনকী অমিত শাহের দিকেও আঙুল তুলেছেন তিনি।
শত্রুঘ্নদের মতো মোদী-বিরোধী শিবিরের পরিচিত মুখ যাঁরা, তাঁদের ক্ষোভ প্রত্যাশিত। কিন্তু মোদীর সামনে বড় সঙ্কট হল, অসন্তোষের বীজ দলের গভীরেও ছড়িয়ে গিয়েছে। সঙ্ঘের এক প্রবীণ নেতা বলেন, ‘‘এখনই হয়তো মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনও নেতা বিজেপিতে নেই, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে দেখা যাচ্ছে এক নিঃশব্দ বিদ্রোহের অশনিসঙ্কেত।’’ ছোট-বড় মাঝারি অনেক বিজেপি নেতাই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার। শুধু সাংসদ নয়, বহু মন্ত্রী, বিধায়ক, পুরসভার কাউন্সিলরও এই দলে রয়েছেন। যদিও দলের মঞ্চে বা মোদী-ঘনিষ্ঠ নেতাদের সামনে মুখে তাঁরা অন্য কথা বলছেন। বিজেপি সূত্রের খবর, ক্ষোভ রয়েছে অনেক মন্ত্রীরও। ক’দিন আগে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মোদীর সামনেই বলেন, ‘‘আপনি মহান কাজ করেছেন। দেশের গরিবরা ধন্য ধন্য করছে।’’ কিন্তু মোদী ঘনিষ্ঠ নেতারাই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী সবই জানেন আড়ালে-আবডালে ওই মন্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে কী বলছেন। দিল্লির এক বিজেপি নেতা সংসদের লবিতে তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বলছেন, ‘‘দিদিকে বলে দিও, আমরাও সঙ্গে আছি। দিদি তুম সংঘর্ষ করো, হাম তুমারে সাথ হ্যায়!’’ বিজেপি নেতাদের অনেকেই চাইছেন, নোট বাতিল নিয়ে আদালতে গিয়ে বিরোধীরা যদি একটি স্থগিতাদেশ আদায় করতে পারেন!
কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লির পুরসভা নির্বাচন। ২০১৫ সালের বিধানসভা ভোটে দিল্লিতে আম আদমি পার্টি বিপুল ভোটে জিতেছিল। বিজেপি এ বার নিজেদের জমি দখল করতে চাইছে। কিন্তু দিল্লির বিজেপি নেতারা বলছেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত তাঁদের বৈশ্য ভোটব্যাঙ্কে বিরাট আঘাত করেছে। দোকানদার ও অন্য ব্যবসায়ীরা টাকার আকাল নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন। বিজেপির ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত শাখা-সংগঠন শীর্ষ নেতৃত্বকে রিপোর্ট দিয়েছে, মুখে খুব ভাল সিদ্ধান্ত বললেও, আর্থিক লোকসানের ফলে কেউ খুশি হতে পারছে না।
শীলা দীক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দিল্লির পুরসভাকে তিন ভাগে ভাগ করে দেন। কিন্তু তার পর ২০০৭ ও ২০১২ সালে বিজেপি এই ব্যবসায়ী –দোকানদারদের ভোটের উপর ভিত্তি করে এই সব পুরসভাগুলি দখল করে। ‘কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনস’-এর সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ খাণ্ডেলওয়াল বিজেপি-ঘনিষ্ঠ নেতা। তিনি বলেন ‘‘আমাদের ব্যবসা শতকরা ৭৫ ভাগ ধাক্কা খেয়েছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। হয়ত ভবিষ্যতে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ক্ষমতা কমতে পারে, কিন্তু আপাতত লোকসান হচ্ছে অনেক। তাই দোকানদাররা কর ছাড় দিতে আবেদন করেছে সরকারের কাছে।’’ দিল্লি বিজেপি সভাপতি সতীশ উপাধ্যায় তাঁদের জনসমর্থনে ধ্বস নামার কথা স্বীকার করে নেন। তবে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ভোটব্যাঙ্কের চেয়ে দেশ বড়।’’
শুধু বিজেপি নয়, ক্ষুব্ধ আরএসএস নেতৃত্বও। দিল্লিতে সঙ্ঘের সদর দফতরের পুনর্নিমাণ হচ্ছে। সে জন্য সদস্য-সমর্থকদের থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ ছাড়া সমাজের অন্য কাজে নিজেদের সামিল করার জন্যও অর্থ সংগ্রহ করে থাকে সঙ্ঘ। আরএসএসের এক নেতা বলেন, ‘‘আমাদের কাজকর্মে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অসুবিধা হচ্ছে।’’
বিজেপির বহু নেতা, যাঁরা এত দিন লালকৃষ্ণ আডবাণীর নাম মুখেও আনতেন না, তাঁরাই এখন চাইছেন এই প্রবীণ নেতা এক বার অন্তত প্রশাসনিক অব্যবস্থা নিয়ে মুখ খুলুন। আডবাণী অবশ্য এদের নিরাশ করেছেন। তাঁদের বলেছেন, ‘‘এই বয়সে বিক্ষুব্ধ নেতা হতে পারব না।’’
বিজেপির এই সব নেতা-মন্ত্রীর অসন্তোষের পিছনে অবশ্য মতাদর্শগত কোনও কারণ নেই। মূলত নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগায়, তাঁরা মোদী বিরোধী হয়ে উঠেছেন। মোদী-ঘনিষ্ঠ এক নেতার মন্তব্য, ‘‘এ হল সম্রাটের বিরুদ্ধে আমির-ওমরাহদের গোপন ষড়যন্ত্র। এর সঙ্গে জনগণের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই অসন্তোষ বিদ্রোহে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা কম।’’