প্রশংসা করো। না হলেই রোষদৃষ্টিতে পড়বে!
গতকাল প্রায় এমনই এক অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন ইকনমিস্ট পত্রিকার সাংবাদিক স্ট্যানলি পিনিয়ল। ‘দোষের’ মধ্যে তিনি নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অভিযোগ, অর্থনীতির জগতে প্রামাণ্য ওই আন্তর্জাতিক পত্রিকায় এই লেখা ছাপার ‘অপরাধেই’ গতকাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ওই সাংবাদিককে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সাংবাদিক বৈঠকে জায়গা কম হওয়ার জন্য কয়েক জনকে ঢুকতে দিতে পারেনি তারা। স্ট্যানলি ছাড়া বিবিসি-র সমির হাশমি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমের আরও কয়েক জনকে এই সাংবাদিক বৈঠকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
এই অভিযোগ-অস্বীকারের টানাপড়েনের মধ্যেই মার্কিন পত্রিকা ‘টাইম’-এর অনলাইন পাঠকদের বিচারে ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ ঘোষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই ঘোষণা হওয়া মাত্রই হইচই পড়ে যায় বিজেপি শিবিরে। টাইম ম্যাগাজিনের খবরকে উদ্ধৃত করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ধন্য ধন্য শুরু করে দেন মোদী-ভক্তরা। পিছিয়ে ছিল না সরকারি গণমাধ্যমও। যে ভাবে সরকারের কৃতিত্ব প্রচার হয়ে থাকে, সে ভাবে আকাশবাণীর খবরের একেবারে প্রথমে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয় মোদীর এই ‘সাফল্য’।
আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় মোদী কী ভাবে সমাদৃত হচ্ছেন সেই ঢক্কানিনাদ চলে গোটা দিন ধরে। শুধু অনলাইন পাঠক নয়, পুরো সমীক্ষায় যে টাইম-এর ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প— সেই তথ্য পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। বেমালুম চেপে যাওয়া হয় আরও একটি দরকারি তথ্য— ‘টাইম’-এর সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে এক জন ব্যক্তির ক্ষমতা ও প্রভাবের ওপর। ফলে টাইম মোদীর ঢালাও প্রশংসা করেছে, সে কথা আদপেই বলা যাবে না।
তবে স্ট্যানলি পিনিয়ল যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অভিযোগ, কাল তাঁকে গলা ধাক্কা দিতে শুধু বাকি রেখেছিল আরবিআই। যার পরে বিরোধীরা বলছেন, অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে ফের নতুন নজির গড়ল মোদী সরকার।
নগদ বাতিলের পরে গতকাল ঋণনীতি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আরবিআই কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানানোর কথা ছিল গভর্নর উর্জিত পটেলের। অন্য সাংবাদিকদের মতো স্ট্যানলিও সেখানে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, পৌঁছনোর পরে স্ট্যানলি জানতে পারেন, তাঁর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন খোদ আরবিআই কর্তৃপক্ষ। বিস্মিত স্ট্যানলি টুইট করেন, ‘‘এটা আরবিআইয়ের নিজস্ব ব্যাপার। তবে আশা করিনি আরবিআই এ ভাবে আমার প্রবেশ বন্ধ করে দেবে।’’ এ আগে আরবিআইয়ের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের তিনটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন স্ট্যানলি।
ফ্রিজে গো মাংস আছে, এই অভিযোগে গণহত্যার শিকার হয়েছেন দাদরির আখলাখ। পেশাগত কারণে মৃত গরুর চামড়া ছাড়াতে গিয়ে দলিত যুবকদের বেধড়ক মার খাওয়ার সাক্ষী থেকেছে গুজরাত-সহ নানা রাজ্য। আড়াই বছরে সরকারের অসহিষ্ণুতার শিকার হতে হয়েছে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। দেশদ্রোহের অভিযোগ তুলে জেলে পোরা হয়েছে কানহাইয়া কুমারের মতো জেএনইউ ছাত্রদের।
রেহাই পায়নি সাংবাদমাধ্যমও। চলতি বছরে তিন মাস ধরে চলা কাশ্মীরের অশান্তির সময়ে সরকারের নির্দেশে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রাখতে হয়েছে রাজ্যের একাধিক সংবাদপত্র। নব্বইয়ের দশকে উপত্যকায় তীব্র জঙ্গি সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও এত দীর্ঘ সময় কাগজ বন্ধ থাকেনি। কোপে পড়েছে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমও। স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস করার অভিযোগে এনডিটিভি ইন্ডিয়া চ্যানেলের সম্প্রচার এক দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করেছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। পরে অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে তারা। সরকারি সিদ্ধান্তের সুরে সুর না-মেলানোয় সময়ের আগে অবসর নিতে হয় প্রসার ভারতীর সিইও জহর সরকারকেও।
সরকারের এই অসহিষ্ণু-মুকুটে নতুন পালক যোগ করল স্ট্যানলি-হেনস্থা। তবে মোদী-ভজনা তাতে বন্ধ থাকেনি। ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের নাম ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ ঘোষিত হওয়ার পরেও বিজেপি দাবি করে, ট্র্যাম্পের মতো মোদীও খেতাব জিতেছেন। এর থেকেই থেকেই মোদী জনপ্রিয়তার আঁচ পাওয়া যায়।
অনলাইন পাঠকের ভোটে ২০১৪ সালেও এই খেতাব পেয়েছিলেন মোদী। সম্পূর্ণ সমীক্ষায় সে বার জিতেছিলেন ইবোলা চিকিৎসকেরা!