Migrant Workers

‘পরিযায়ী’ নামকরণেই অসম্মান, স্বার্থরক্ষা হবে কী করে

পাখি থেকে মানুষ, মানুষ থেকে শ্রমিক, শ্রমিক থেকে পরিযায়ী শ্রমিক— আস্থা হারানোর এ প্রক্রিয়া আসলে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২০ ০৩:৫৮
Share:

ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। ছবি: এএফপি।

১৬৭২ সালে স্যার টমাস ব্রাউন ‘লেটার টু আ ফ্রেন্ড’-এ প্রথম ‘মাইগ্র্যান্ট’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। পরিযায়ী প্রাণী, মূলত পাখিদের ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল বলে জানাচ্ছে অক্সফোর্ড অভিধান। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, বহু পরে মানুষ ও অন্য প্রাণী, উভয় ক্ষেত্রেই ‘মাইগ্র্যান্ট’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।

Advertisement

আর বাংলার ক্ষেত্রে পরিযায়ী শব্দের ব্যবহার?

ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘বাংলায় পরিযায়ী এসেছে সংস্কৃত পরিযাণ শব্দ থেকে। ফলে ধরে নেওয়া যেতে পারে শব্দটি কমপক্ষে দু’হাজার বছরের পুরনো। তবে বাংলাতেও এ শব্দ ব্যবহার হত পাখিদের ক্ষেত্রেই। কবে মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু হল, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: কড়া লকডাউনেও কেন বাড়ছে করোনা-সংক্রমণ? প্রশ্নের মুখে অস্বস্তিতে কেন্দ্র

কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রেক্ষিতে ‘মাইগ্র্যান্ট’ বা ‘পরিযায়ী’ শব্দটির মাধ্যমে দেশেরই এক শ্রেণির নাগরিককে অসম্মান করা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রাজ্যে মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সায়কায়াট্রি’-র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক প্রশান্তকুমার রায় বলছেন, ‘‘কাজের সূত্রে বা অন্য কারণে অন্যত্র যাওয়া অনেকেই তো পরিযায়ী। কিন্তু আর্থিক ফারাকটা বোঝাতেই পরিযায়ী শ্রমিক শব্দটির সচেতন ব্যবহার চলে এসেছে।’’ মনোবিদদের একাংশের বক্তব্য, কোনও শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে ‘সোশ্যাল রোল ভ্যালরাইজেশন’-এর ধারণাটি যুক্ত রয়েছে। যার সহজতম অর্থ, সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সমাজে তাঁর গুরুত্ব বোঝানো। এক মনোবিদের কথায়, ‘‘সেখানে পরিযায়ী শ্রমিক শব্দটি ব্যবহার করলে এক শ্রেণির মানুষের মৌলিক অধিকার অগ্রাহ্য করার কাজটা সহজ হয়ে যায়।’’ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ‘দ্য ওয়ার্কিং গ্রুপ অন মাইগ্রেশন’-এর রিপোর্টে যে মেকআপ আর্টিস্ট চারু খুরানার মামলার উল্লেখ করা হয়েছিল, সেই মামলার আইনজীবী তথা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য জয়তিকা কালরা বলছেন, ‘‘পরিযায়ী শব্দটি সম্মানজনক নয়। শুধু কর্মী বা শ্রমিক বলা হোক। কিন্তু যেহেতু এই বিষয়ে আইন রয়েছে, তাই তার সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দেই কিছু যায় আসে না।’’

তবে সারা বিশ্বেই ‘মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স’ শব্দটির মধ্যে এক শ্রেণির মানুষের বিপন্নতা লুকিয়ে রয়েছে বলে আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য লিঙ্গুইস্টিক্স অব ইংলিশ’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট (রিসার্চ) প্রফেসর মার্টিন হিলপার্ট। তাঁর কথায়, ‘‘করপাস অব হিস্টরিক্যাল আমেরিকান ইংলিশ (যা আদতে ১৮১০-২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ কোটি ইংরেজি শব্দের ভাণ্ডার) ও নিউজ অন দ্য ওয়েব করপাস (যা ইন্টারনেট নিউজপেপার ও ম্যাগাজিনে ব্যবহৃত প্রায় হাজার কোটি শব্দের ভাণ্ডার)— ইংরেজি টেক্সটের এই দু’টি বৃহৎ তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে দেখেছি, মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স শব্দটি মূলত ‘এক্সপ্লয়টেশন’ (বঞ্চনা, শোষণ), ‘পুয়োর’ (দরিদ্র), ‘প্লাইট’ (দুরবস্থা)-এর মতো একাধিক প্রসঙ্গে সবথেকে বেশি উল্লিখিত হয়েছে। শব্দগুলির মাধ্যমে আসলে তাঁদের বঞ্চনাই ফুটে উঠেছে।’’

আরও পড়ুন: দুঃখে দুঃখী, কিন্তু হাত উপুড় নয় মোদীর

অথচ এ দেশে সেই সত্তরের দশকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বঞ্চনা আটকাতে আইন তৈরি হয়েছিল। সে সময় ওড়িশা-সহ একাধিক রাজ্যে সর্দার বা খাতাদার নামক একটি শ্রেণি রাজ্যেরই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমিকদের এক রকম মজুরি দেওয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের শোষণ করত। ‘দ্য কন্ট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবলিশন) অ্যাক্ট, ১৯৭০’ থাকা সত্ত্বেও তা থামছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘চিফ লেবার কমিশনার (সেন্ট্রাল)’ অফিস সূত্রের খবর, সমস্যার সমাধানে ১৯৭৯-এ ‘দ্য ইন্টার-স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন (রেগুলেশন অব এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশন্স অব সার্ভিস)’ আইন হয়।

কিন্তু যাঁদের জন্য আইন, তাঁদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হলে তাঁদের স্বার্থও যে সুরক্ষিত থাকে না, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি! ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর ‘দ্য সেন্টার ফর স্টাডি অব সোশ্যাল এক্সক্লুশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ পলিসি’র প্রফেসর আভত্তি রামাইয়া বলছেন, ‘‘পরিযায়ী শ্রমিকদের শ্রমকে কোনও রাজ্য অস্বীকার করতে পারবে না। অথচ দেশ হিসেবে এই মানুষগুলোর বিশ্বাস, আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলেছি!’’

পাখি থেকে মানুষ, মানুষ থেকে শ্রমিক, শ্রমিক থেকে পরিযায়ী শ্রমিক— আস্থা হারানোর এ প্রক্রিয়া আসলে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। কোভিড-১৯ তা প্রকাশ্যে এনেছে মাত্র। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, সারা দেশে পরিযায়ী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি। এত সংখ্যক মানুষের আস্থা, বিশ্বাস খুইয়ে ভারতের ভিত অক্ষত থাকবে তো? প্রশ্ন অনেকের।

কারণ, সংক্রমণ তো থামবেই। কিন্তু তার পরে এ দেশকে এই বিশ্বাস হারানোর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। দিতে হবেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন