লালকেল্লার সামনে গাড়ি বিস্ফোরণ নিয়ে প্রস্তাব পাশ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
দিল্লিতে লালকেল্লার সামনে গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনা সন্ত্রাসবাদী হামলাই। বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বৈঠকের পর সেই তত্ত্বে সিলমোহর দিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার ভুটান সফরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরেই হাসপাতালে আহতদের সঙ্গে দেখা করতে যান। তার পর মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠক শেষে সোমবারের ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’ বলে উল্লেখ করল নয়াদিল্লি। জরুরি ভিত্তিতে এবং কঠোর পেশাদারিত্বের সঙ্গে বিষয়টির মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে।
বৈঠকের পর লালকেল্লার সামনে বিস্ফোরণে নিহতদের আত্মার শান্তিকামনায় দু’মিনিট নীরবতা পালন করেন প্রধানমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিসভার সদস্যেরা। তার পর গোটা ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে প্রস্তাব পাশ করা হয়। বলা হয়েছে, সরকার এই সংক্রান্ত পরিস্থিতি এবং তদন্তের দিকে নজর রেখেছে। অবিলম্বে যাতে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়, তা নিশ্চিত করা হবে। এর জন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনাকে ‘অনর্থক হিংসা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে নয়াদিল্লির বিবৃতিতে। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছে সরকার। এ ছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ঘটনার পর যে সমস্ত দেশ ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে কেন্দ্র।
দিল্লির ঘটনার নেপথ্যে যে বড়সড় ষড়যন্ত্র রয়েছে, আগেই তা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বুধবার তাকে সরাসরি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা বলে দেগে দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ প্রমুখ। গত দু’দিনে অনেকটা এগিয়েছে দিল্লির ঘটনার তদন্ত। একাধিক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক নতুন তথ্য পাওয়া গিয়েছে। বুধবারই হরিয়ানার গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অন্যতম অভিযুক্ত উমর নবির লাল রঙের চারচাকার গা়ড়ি। এই উমরই বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া সাদা হুন্ডাই আই২০ গাড়ির চালকের আসনে ছিলেন মনে তদন্তকারীদের ধারণা।
গাড়ির গতিবিধি
হুন্ডাই আই ২০ গাড়িটি বিস্ফোরণের আগে কোথায় কোথায় ঘুরেছিল, তা গোয়েন্দাদের নজরে। তদন্তে উঠে এসেছে দিল্লির দুই ব্যস্ততম জায়গার নাম— কনট প্লেস এবং ময়ূর বিহার। লালকেল্লায় আসার আগে ওই গাড়িটিকে দেখা যায় রাজধানীর ওই দুই জনবহুল এবং ব্যস্ততম এলাকায়! দিল্লি আসার আগে ওই গাড়িটি হরিয়ানাতেই ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্রের দাবি, গত ২৯ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ফরিদাবাদের আল-ফালাহ্ মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসে পার্ক করা ছিল বিস্ফোরণে ব্যবহৃত সেই গাড়িটি। তার পাশেই রাখা ছিল ধৃত চিকিৎসক মুজ়াম্মিল আহমেদের গাড়িও। যদিও গাড়ির মালিক মুজ়াম্মিল হলেও রেজিস্ট্রেশন ছিল মহিলা চিকিৎসক শাহিন শহিদের নামে। তা হলে কি বিস্ফোরণের আগে রেকি করতেই রাজধানীর জনবহুল এলাকাগুলি ঘুরেছে গাড়িটি? লালকেল্লা ছাড়াও রাজধানীর অন্য কোথাও আত্মঘাতী হামলার ছক ছিল? যদিও দিল্লি বিস্ফোরণ নেপথ্যে আত্মঘাতী হামলার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি।
লাল গাড়ি উদ্ধার
হরিয়ানার খাণ্ডওয়ালি গ্রাম থেকে লাল রঙের ফোর্ড ইকোস্পোর্ট গাড়ি উদ্ধার করা হচ্ছে। তার মালিক উমর, যিনি ঘাতক গাড়িটিতে ছিলেন বলে সন্দেহ। এই গাড়িতে বিস্ফোরক থাকতে পারে বলে সতর্ক করেছেন গোয়েন্দারা। মিলতে পারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ ছাড়া, দিল্লি এবং সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে পুরনো গাড়ি বিক্রেতাদের সম্প্রতি বিক্রি করা গাড়িগুলির তথ্য যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন আধিকারিকেরা। আটক করা হয়েছে এক গাড়ি বিক্রেতাকেও। স্পেশাল সেলের এক আধিকারিক পিটিআইকে জানান, বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া গাড়িটির মালিকানা কী ভাবে হস্তান্তর হয়েছে, সেই পুরো শৃঙ্খলটি যাচাই করা হচ্ছে।
সন্ত্রাসবাদী হামলা
দিল্লিতে সোমবারের বিস্ফোরণের ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদী হামলা বলে উল্লেখ করল ভারত সরকার। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে। তার পরেই বিবৃতি দিয়ে এই ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদী হামলা বলা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে কঠোর পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে। অবিলম্বে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছে সরকার।
উমর কি পালাচ্ছিলেন?
দিল্লি বিস্ফোরণকাণ্ডে ‘ঘাতক’ সেই গাড়ির চালক চিকিৎসক উমর উন-নবি ওরফে উমর মহম্মদ কি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন? ফরিদাবাদ থেকে বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে সেই কারণেই রওনা হয়েছিলেন দিল্লির উদ্দেশে? তদন্তকারীদের একাংশ তেমনটাই মনে করছেন। কাশ্মীর, ফরিদাবাদ এবং সাহারানপুর থেকে একে একে তাঁর সঙ্গীরা ধরা পড়ছিলেন। হতে পারে, সেই কারণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন উমরও। সোমবার সকালেই ফরিদাবাদ থেকে ৩৬০ কেজি আরডিএক্স তৈরির মশলা উদ্ধার করেছিল পুলিশ। উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে মোট উদ্ধার হওয়া বিস্ফোরকের পরিমাণ ছিল ২৯০০ কেজি। কেউ কেউ মনে করছেন, ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই ‘প্রমাণ’ লোপাট করতে অবশিষ্ট বিস্ফোরক দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলা হয়।
ফরিদাবাদের মেডিক্যাল কলেজের বিবৃতি
ফরিদাবাদের আল-ফালাহ্ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন দিল্লি বিস্ফোরণকাণ্ডে জড়িত দুই চিকিৎসক মুজ়াম্মিল আহমেদ এবং শাহিন শহিদ। জানা গিয়েছে, শ্রীনগরে জইশ-ই-মহম্মদের সমর্থনে পোস্টার সাঁটানোর অভিযোগে ধৃত আদিল মাজ়িদ রাথরের সঙ্গেও যোগ রয়েছে ফরিদাবাদের এই হাসপাতালের। বুধবার তারা বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছে, তারা সন্ত্রাসবাদীদের ‘আখড়া’ নয়। ধৃত বা আটক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের সুনাম নষ্টের চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে।
হাসপাতালে মোদী
ভুটান থেকে ফিরেই দিল্লিতে বিস্ফোরণে আহতদের দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ (এলজেএন) হাসপাতালে এখনও অন্তত ২০ জন চিকিৎসাধীন। তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের তদন্ত সংস্থাগুলি এই ষড়যন্ত্রের শিকড় পর্যন্ত যাবে। যারা যারা এই ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা হবে। একজনকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না।’’
বাংলায় এনআইএ
দিল্লির বিস্ফোরণকাণ্ডের তদন্তে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে এনআইএ-র একটি দল। মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের নিমগ্রামে এক ঠিকাশ্রমিকের বাড়িতে তারা তল্লাশি চালিয়েছে। জেলার আরও কিছু এলাকায় এনআইএ ঘুরেছে। এই ঘটনায় ধৃত এক জনের মোবাইল থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে মুর্শিদাবাদে পৌঁছেছেন গোয়েন্দারা। সন্দেহ, বিভিন্ন শহরে কাজের সূত্রে জঙ্গি সংগঠনের কয়েক জন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ঠিকাশ্রমিক মইনুল হাসানের। তিনি বাড়িতে ছিলেন না।
সন্ত্রাসের ‘সাপ্লাই লাইন’
দিল্লি বিস্ফোরণকাণ্ডের তদন্তে নেমে কাশ্মীরের বাসিন্দা ইরফান আহমেদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি শ্রীনগর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন কর্মী ছিলেন। অভিযোগ, মেডিক্যাল পড়ুয়াদের মগজধোলাই করতেন এই ইরফান। সন্ত্রাসের ‘সাপ্লাই লাইন’ করে তুলেছিলেন ওই হাসপাতালটিকে। ডাক্তারি পড়ুয়াদের নানা সন্ত্রাসমূলক কাজে প্ররোচিত করতেন তিনি। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের দাবি, নওগামের মসজিদে যে সব পড়ুয়ারা যেতেন, ইরফান তাঁদের সঙ্গে প্রথমে আলাপচারিতার মাধ্যমে বন্ধুত্ব করতেন। তার পর ধীরে ধীরে ওই পড়ুয়াদের সন্ত্রাসবাদের পাঠ দিতেন।
মহিলা চিকিৎসকের ভূমিকা
দিল্লির লালকেল্লার বাইরে বিস্ফোরণের ঠিক আগে লখনউ থেকে গ্রেফতার হন এক মহিলা চিকিৎসক। নাম শাহীন সিদ্দীকী। তাঁর গাড়ি থেকে মেলে আগ্নেয়াস্ত্র। শাহীন এবং তাঁর সঙ্গী মুজ়াম্মিলের সঙ্গে দিল্লি বিস্ফোরণকাণ্ডের সরাসরি যোগ থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। একসময় কানপুরের জেএসভিএম মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করতেন শাহীন। তবে চাকরি করতে করতেই ২০১৩ সালে আচমকা উধাও হয়ে যান। এর প্রায় আট বছর পর ২০২১ সালে চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করেন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। মনে করা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন শাহীন। সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের মহিলা শাখা জামাত-উল-মোমিনীনের ভারতের প্রধান করা হয় তাঁকে। তিনি কাজ করতেন মাসুদ আজ়হারের বোন সাদিয়া আজ়হারের সঙ্গে পরামর্শ করে। লখনউয়ে যে বাড়িতে শাহীন থাকতেন, সেখান থেকে তাঁর ভাই পরভেজ আনসারিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রজাতন্ত্র দিবসে হামলার ছক?
তদন্তকারীদের অনেকের মতে, ১০ নভেম্বর নয়। আসলে গত ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন লালকেল্লায় হামলার ছক কষা হয়েছিল। ধৃত মুজ়াম্মিলের ফোনের তথ্য ঘেঁটে জানা গিয়েছে, তিনি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একাধিক বার লালকেল্লার সামনে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন চিকিৎসক উমরও। নিরাপত্তার কারণেই তখন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়নি, মত একাংশের।
ঘটনাস্থলে কী কী মিলল
লালকেল্লার কাছে ঘটনাস্থল থেকে দু’টি তাজা কার্তুজ এবং দু’ধরনের বিস্ফোরকের নমুনা পাওয়া গিয়েছে। কার্তুজ দু’টি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের দাবি, ঘটনাস্থল থেকে নমুনা পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে একটি অ্যামেনিয়াম নাইট্রেটের মতো কোনও রায়াসনিক হতে পারে। তবে দ্বিতীয় বিস্ফোরকের প্রকৃতি সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য মেলেনি। পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার পরই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের সংখ্যা বিবেচনা করে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, মিলিটারি-গ্রেডের বিস্ফোরক নিয়ে ঘুরছিলেন সন্দেহভাজন। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, সম্ভবত পিইটিএন (পেন্টেরিথ্রিটল টেট্রানাইট্রেট), সেমটেক্স বা আরডিএক্স-এর মতো শক্তিশালী বিস্ফোরক ছিল গাড়িতে। এগুলির কোনও ক্ষেত্রেই বিস্ফোরণে পেলেট কিংবা শার্পনেল প্রয়োজন হয় না। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং ডিটোনেটরের সম্ভাব্য ব্যবহারেরও ইঙ্গিত মিলেছে। কারণ, বিস্ফোরণের পরেই নাকি কমলা রঙের আগুনের শিখা দেখা গিয়েছিল, যা সাধারণত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বিস্ফোরণ ঘটলে দেখা যায়।