মশগুল প্রাক্তনী সুন্দর পিচাই। খড়্গপুর আইআইটিতে ছাত্রদের সঙ্গে এক আলোচনায় গুগলের সিইও। বৃহস্পতিবার। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
চেন্নাইয়ের ছেলে। হিন্দিতে তেমন সড়গড় ছিলেন না। মেসে প্রথম এসে ধারণা হয়েছিল, ‘আ বে স্সালে’ বলে অন্যকে ডাকাই বুঝি এখানে দস্তুর। কিন্তু তার ধাক্কাটা টের পেয়েছিলেন বলে ফেলার পরে। ঝামেলায় দিন তো বরবাদই, তখনকার মতো তালাও পড়ে গিয়েছিল মেসের দরজায়!
হস্টেল ছাড়ার ২৩ বছর পরে এমন অজস্র টুকরো গল্পের কোলাজ বেয়ে আইআইটি-খড়্গপুরে ফিরলেন সুন্দর পিচাই। বৃহস্পতিবার টেগোর ওপেন অ্যাম্ফিথিয়েটারের মঞ্চে যে পিচাইকে পাওয়া গেল, তিনি বছরে ৬,৬০০ কোটি ডলার ব্যবসা করা গুগ্লের কর্ণধার নন। ৬০ হাজার কর্মীর ‘বস’ও নন। নেহাতই আইআইটি-খড়্গপুরের গর্বিত প্রাক্তনী।
এ দিন দুপুর বারোটা আঠেরোয় মঞ্চে পা রাখলেন পিচাই। হালকা নীল শার্ট, কালো ট্রাউজার, চশমা আর গালে সযত্ন কাঁচা-পাকা দাড়ি। লম্বা, রোগা চেহারা আর শান্ত একজোড়া চোখ। চাইলে অনায়াসে অধ্যাপক বলে চালিয়ে দেওয়া চলে। কিন্তু তিনি যে তারকা, তা মালুম হল তাঁকে দেখামাত্র সাড়ে তিন হাজার পড়ুয়ার তীব্র চিৎকারে। হাততালি, ‘আইআইটি’র নামে জয়ধ্বনি, ইতিউতি সিটিও। এক কথায়, ‘রকস্টার ওয়েলকাম’।
সবে নিজের পুরনো মেস আর ডর্ম রুম ঘুরে এসেছেন। তার উপর মঞ্চে বসতেই দু’পাশের বিশাল পর্দায় ভেসে উঠল খানতিনেক সাদা-কালো ছবি। পিচাইয়েরই, তবে আইআইটি-তে পড়াকালীন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। তার মধ্যে একটি আবার মেসে বসে খাওয়ার। পিচাই প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘‘মেসে সম্বর আর ডালের ফারাক খোঁজা নিয়ে রসিকতা কি এখনও চালু?’’ বোঝা গেল, মার্কিন মুলুকে প্রায় আড়াই দশক কাটানোর পরেও জোলো ডালের স্বাদ তাঁকে ছাড়েনি।
কখনও সঞ্চালক প্রশ্ন করলেন, কখনও তা উড়ে এল পড়ুয়াদের কাছ থেকে। হাসতে-হাসতে প্রায় সব ক’টির উত্তর দিলেন পিচাই। এড়িয়ে গেলেন একটিই, ‘‘আপনার মেসের দেওয়ালে কার পোস্টার ছিল?’’ মৃদু হেসে শুধু বললেন, পোস্টার নিয়ে কিছু বলতে চান না। কিছু না-বলেও প্রায় সবই বোঝানো গেল।
এই হস্টেল জীবনের কথা বলতে গিয়েই এ দিন স্মৃতির ঝাঁপি উজাড় করলেন পিচাই। কিছুটা ফাঁক করলেন ব্যক্তিগত জীবনের খিড়কিও। বললেন, এখানেই (স্ত্রী) অঞ্জলির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। কিন্তু তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করাটাই মস্ত হ্যাপা ছিল। গুটিগুটি পায়ে মেয়েদের হস্টেলের সামনে গিয়ে অঞ্জলিকে একটু ডেকে দেওয়ার জন্য বলতে হতো। কিন্তু চুপিসারে হওয়ার জো ছিল না। কারণ, যাঁকে অনুরোধ করা হতো, তিনি অবধারিত ভাবে জোরে হাঁক পাড়তেন— ‘‘অঞ্জলি, সুন্দর দেখা করতে এসেছে।’’ প্রতিবারই অপ্রস্তুত হতে হতো লাজুক পিচাইকে।
২০১৫ সালের অগস্টে সুন্দরকে গুগ্লের শীর্ষ পদে বসানোর দিনে সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ বলেছিলেন, ‘‘আমি ভাগ্যবান যে, সুন্দরের মতো মেধাবী, পরিশ্রমী আর দায়বদ্ধ লোক সংস্থা চালাবেন।’’
পিচাই-পছন্দ
•অবসরে
•দুই সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো। ফুটবল ও ক্রিকেট দেখা।
•আদর্শ
•এন আর নারায়ণ মূর্তি, সচিন তেন্ডুলকর প্রমুখ
•প্রিয় অভিনেত্রী
•দীপিকা পাড়ুকোন
•প্রিয় ক্রিকেটার
•বিরাট কোহালি
•প্রিয় শিক্ষক
•প্রফেসর রায় ও প্রফেসর ইন্দ্রনীল মান্না
সেই সুন্দর কিন্তু এ দিন কবুল করলেন, আইআইটি-তে পড়াকালীন তিনিও ক্লাস পালিয়েছেন। প্রথম বছরে রেজাল্টও বেশ খারাপ হয়েছিল। কিছু পরীক্ষায় জুটেছিল ‘সি’ গ্রেড! তবে পরে তা পুষিয়ে দিতে পরিশ্রমও করেছিলেন পুরোদমে।
আর র্যাগিং? হাসিমুখে পিচাই জানালেন, ‘‘ঘর গুছিয়ে তালা লাগিয়ে বেরোতাম। ফিরে দেখতাম গোটা ঘর লণ্ডভণ্ড। অথচ দরজায় তালা ঝুলছে একই রকম।’’
আতান্তরে অবশ্য তাঁকে পড়তে হয়েছিল গুগ্লে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েও। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল। প্রথম চার রাউন্ডে তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল, গুগ্লের নতুন ই-মেল পরিষেবা জি-মেলের কথা তিনি জানেন কি না। জানা তো দূর অস্ত্, বরং ভেবেছিলেন ‘এপ্রিল ফুল’ করা হচ্ছে তাঁকে। অথচ বছর দশেক পরে সেই গুগ্লেরই সিইও হয়ে বসলেন তিনি!
জীবনের প্রতি পরতে যে এমন বহু বৈপরীত্য ছড়িয়ে রয়েছে, তা এ দিন হাট করে মেলে ধরেছেন পিচাই। জীবনে প্রথম কম্পিউটার দেখেছিলেন আইআইটিতে এসে। অথচ এখন বাড়িতেই ৩০০টি স্মার্টফোন। জীবনের প্রথম বিমানে চড়া মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেওয়ার সময়। অথচ তার পর থেকে পায়ের তলায় সর্ষে। চষে বেড়াতে হচ্ছে সারা দুনিয়া।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইআইটি-পড়ুয়াদের অনেকেই তাঁর মতো হতে চান। তার টোটকা? পিচাইয়ের দাওয়াই, ‘‘অল্পে ভেঙে পড়ো না। ভয় পেও না ঝুঁকি নিতে। সেটাই করো, যা মন চায়।’’ তাঁর মতে, পড়াশোনা জরুরি। তবে তার চেয়েও জরুরি হাতেকলমে শিক্ষা। প্রয়োজন নতুন কিছু করা আর ভাবার তাগিদও।
পড়ুয়াদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কিছু গম্ভীর প্রসঙ্গও ছুঁয়ে গেলেন। জানালেন, ডিজিটাল দুনিয়ায় বড় শক্তি হয়ে উঠতে লাফ দেওয়ার জন্য তৈরি ভারত। তবে তার জন্য দরকার দু’হাজার টাকার মধ্যে ভাল স্মার্টফোন, উন্নত নেট পরিকাঠামো। তা তৈরিতে ও ডিজিটাল লেনদেনে গুগ্ল হাত বাড়াবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
পোড়খাওয়া পেশাদার উঁকি মারল একবারই। এক পড়ুয়ার প্রশ্ন এল, ‘‘গুগ্লকে হঠাতে কী করা জরুরি?’’ হেসে উত্তর দিলেন, ‘‘কী স্বপ্ন দেখছ, আগে সেটা বুঝে নেওয়া ভাল।’’ তবে একই সঙ্গে বললেন, ‘‘না হয় চায়ে চুমুক দিয়ে সেটা ভাবা যাবে।’’
গুগ্ল কর্ণধার এ দিন বলছিলেন, ‘‘পড়া শেষে কলেজ, নেহরু হল ছেড়ে খড়গপুর স্টেশনে যখন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন মনে একরাশ দুঃখ।’’ কিন্তু ২৩ বছর পরে এ দিন সম্ভবত খুশি মনেই ফিরলেন তিনি। কারণ, এ দিন আস্ত ক্যাম্পাসই যেন প্রগাঢ় ভালবাসায় ‘আ বে স্সালে’ বলে জড়িয়ে ধরল তাঁকে।
হয়তো তুলনা টানা বাড়াবাড়ি। তবু কোনও এক ‘ইডিয়ট’ র্যাঞ্চোর কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল।