স্বপ্নের উড়ান একেই বলে কী? স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে এমনটাই হয়তো ভাবছিলেন ওঁরা। জলগাঁওয়ের সেই রুখুশুখু মাঠ, ফসলহীন ক্ষেত, ঘরে চাল বাড়ন্ত, আত্মঘাতী কৃষকভাইদের মুখ— অনেক কিছুই মনে পড়ছিল। আর এই না পাওয়াগুলোই যেন দৃপ্ত স্বরে আছড়ে পড়ল হার্ভার্ডের সেমিনারে। ওঁরা দু’জন। খরা ও কৃষক মৃত্যুতে ফি বছর যে জলগাঁও নাম তোলে খবরের কাগজে, ওঁরা সেখান থেকেই উঠে এসেছেন। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন ওঁরা। লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছিলেন দাঁতে দাঁত চেপে। আজ বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ও কুর্নিশ জানাচ্ছে এই দুই ভারতীয় কৃষককে।
গল্পটা ঠিক কী?
প্রথমে বলা যাক রাজেন্দ্র হরি পটেলের গল্পটা। আসলে গল্প নয়, সবটাই বাস্তব। কঠোর বাস্তব। কিন্তু শুনতে যেন গল্প কথার মতোই। মহারাষ্ট্রের জলগাঁও জেলার ওয়াড়ে গ্রাম। আদ্যন্ত কৃষক পরিবারে জন্ম রাজেন্দ্রর। সাত ভাইবোনের সংসারে ছোট ছেলে রাজেন্দ্র। কিন্তু এগারোর কোঠায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই বাবা মারা গেলেন। সম্বল বলতে দেড় একর জমি। দাদাদের সঙ্গে সেই জমিতেই কাজে লেগে গেলেন রাজেন্দ্র। চাপা জেদের বীজটা ছোট থেকেই পুষতেন মনের ভিতরে। যত কষ্টই হোক, পড়াশোনা ছাড়লেন না রাজেন্দ্র হরি।
রাজেন্দ্র হরি পটেল
রাসায়নে স্নাতক হলেন রাজেন্দ্র। এর পর শরীরবিদ্যা নিয়ে মাস্টার্স পাস করে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলেন। কিন্তু নাড়ির টানে যাঁর মাটির গন্ধ- ক্লাসের চক, টেবিল, ডাস্টারে তাঁর মন বসল না। ছেড়ে দিলেন চাকরি। লাঙ্গল হাতে ফের ফিরে গেলেন জমির কাছে। আবার শুরু হল চাষবাষ। ২০০৬ সালে যোগ দিলেন জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেডে। রাজেন্দ্রর কথা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু তার আগে পরিচয় করে নেওয়া দরকার হেমচন্দ্র দাগাজি পটেলের সঙ্গে।
জলগাঁও জেলার পঞ্চক গ্রামের বাসিন্দা হেমচন্দ্র। বাবা চাইতেন ছেলেরা পড়াশোনা করে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়র বা উকিল হোক। বাবার ইচ্ছার মর্যাদা রেখেছিলেন কৃষক পরিবারে জন্মানো হেমচন্দ্র। আইনজীবী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মনটা পড়ে থাকত সাদা জামা, কালো কোটের ধরাচূড়োর বাইরে। উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন ৩০ একর জমি। আইনজীবীর পেশা ছেড়ে দিলেন। ছোটো থেকেই ফার্মের কাজে বাবাকে সাহায্য করতেন।
আরও পড়ুন: বাঙালি বিজ্ঞানীর হাত ধরে ‘আবেগপ্রবণ’ হচ্ছে রোবট
হেমচন্দ্র দাগাজি পটেল
ভালবাসাটা তখন থেকেই জড়িয়ে ছিল। তাই নিজের স্বপ্ন উড়ানে বাবার সমর্থন পেয়েছিলেন ষোলো আনা। ২০০০ সালে এক সেমিনারে যোগ দেওয়ার পর বদলে যায় তাঁর জীবন।
এ বার আর একজনের কথা শোনাবো। ভবরলাল জৈন। জেলা একই। তবে ভবরলালের বাড়ি জলগাঁওয়ের ওকদ গ্রামে। কৃষক পরিবারে জন্ম। বেড়েও ওঠা চাষাবাদের আবহেই। কিন্তু স্বচ্ছলতা কী কোনও দিন চোখে দেখেননি। ঠেলাগাড়ি করে কেরোসিন বিক্রিও করেছেন বাড়ি বাড়ি। কিন্তু শত কষ্টেও পড়াশোনা ছাড়তে চাননি ভবরলাল।
ভবরলাল জৈন
আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, পেয়েছিলেন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার সুযোগও। কিন্তু আগ্রাহ্য করলেন সেই সব। মাত্র ২৩ বছর বয়সে যোগ দিলেন পারিবারিক কৃষিকাজে। এর পর তিন প্রজন্মের সম্মিলিত সঞ্চয় মাত্র ৭০০০ টাকা সম্বল করে শুরু করলেন নিজের ব্যবসা। ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন ‘জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেড’। বিভিন্ন রকমের চাষের যন্ত্রপাতি, হরেক সরঞ্জাম তৈরি করে এই কোম্পানি। শুধু তাই নয়, গাছের চারা, বীজ, সার, কীটনাশক তৈরিতেও আজ দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য এই কোম্পানি। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যেই ২৯টি শাখা খুলেছে ‘জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেড’। পকেটে পুরেছেন ২২টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড। ১৯৮৮ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানও।
ভবরলালের স্বপ্নে তৈরি ‘জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেড’
এখনও প্রতি বছর সারা দেশের ৪০ হাজার কৃষককে জলগাঁওতে আমন্ত্রণ জানান ভবরলাল। সেখানে বিশেষজ্ঞরা চাষবাস সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেন। কী ভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও ফলন বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দান করেন। আর এই পুরো কর্মকান্ডের ব্যয়ভার বহন করে ‘জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেড’।
‘জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেড’ কৃষক সম্মেলন
রাজেন্দ্র, হেমচন্দ্র আর ভবরলাল তিন জন আলাদা ব্যক্তিত্ব হলেও, কোথাও একটা গিয়ে মিলে গিয়েছে তাঁদের কাহিনী। ‘জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেড’-এর এই সেমিনারেই একবার যোগ দিয়েছিলেন রাজেন্দ্র আর হেমচন্দ্র। জীবনটা বদলে যায়। দু’জনেই যোগ দেন জৈন কোম্পানিতে।
‘‘সেমিনারে যেমনটা শিখেছিলাম তেমন ভাবেই ২০০৬-এ প্রথম ১০,০০০ কলার টিস্যু কালচার করেছিলাম। ১০ মাস পরে বেশ ভাল ফল পেলাম। পরের বছর ১৮,০০০ চারার টিস্যু কালচার করলাম। দুর্দান্ত ফলাফল পেলাম’’— বললেন রাজেন্দ্র।
এভাবেই এখন কোটি টাকা রোজগার করছেন তাঁরা।
এক মঞ্চে তিন কৃতী
২০১১ সালে জীবনে এল বড় মর্যাদার ডাক। জীবনের ‘হ্যালো হার্ভার্ড’ পর্ব।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে যখন ‘খাদ্য সুরক্ষা পদ্ধতি’ নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করা হয় তখন ভারত থেকে সেখানে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাক পান রাজেন্দ্র ও হেমচন্দ্র। ১৫ মিনিটের বক্তৃতায় খাদ্য সুরক্ষার নানান দিক তুলে ধরেন তাঁরা।
হার্ভার্ডের মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন রাজেন্দ্র
এখন প্রায়ই বিদেশ থেকে সেমিনারে যাওয়ার ডাক পান হেমচন্দ্র। নিজের বিশাল ফার্মে চাষবাসও চলে জোর কদমে। দেশ বিদেশ থেকে সেখানকার কাজ দেখতে আসেন উৎসাহীরা।
প্রতি বছর অন্তত ৪০-৫০ হাজার কলা চাষ করেন রাজেন্দ্র। সম্প্রতি চলিশগাঁও-এ প্রায় দেড় কোটি টাকার বিশাল বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। সকলকে বলেন, চাষ করাও ‘হাই প্রোফাইল’ চাকরিকে হার মানাতে পারে। শুধু দরকার পাখির চোখটাকে দেখা।
নিজেদের কাজ দেখাচ্ছেন হেমচন্দ্রও রাজেন্দ্র
২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মুম্বইয়ের যশলোক হাসপাতালে ‘মাল্টি ওরগ্যান ফেলিওর’ হয়ে মারা যান ভারতের দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের নায়ক ভবরলাল জৈন। কিন্তু ‘জৈন ইরিগেশন সিস্টেম লিমিটেড’-এর সঙ্গে রেখে গিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষের স্বাবলম্বী ভবিষ্যত।